এইদিন ওয়েবডেস্ক,৩০ জানুয়ারী : হিন্দু বহুল ভারতে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন জওহরলাল নেহেরু । ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের কথা ভারতের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় । কিন্তু বিশ্বের এমন একটি দেশ আছে যেখানে হিন্দু জনসংখ্যা এক শতাংশের নিচে,অথচ সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘রামরাজ্য’ । দেশটির জাতীয় ধর্মগ্রন্থ রামায়ন । পাশাপাশি সমাজে রয়েছে হিন্দু দেবদেবীদের প্রাধান্য । আর ওই দেশটি হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট দেশ থাইল্যান্ড ।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত রাষ্ট্রটির ২০২০ সালের জনগননা অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৮০,০০০ জন বা জনসংখ্যার ০.১ শতাংশ হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করে। তা সত্ত্বেও দেশটিতে হিন্দু ধর্মের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে । থাইল্যান্ডে এখনও সাংবিধানিক আকারে ‘রামরাজ্য’ বিদ্যমান । সেখানে বর্তমানে রাজত্ব করছেন ভগবান রামের কনিষ্ঠ পুত্র কুশের বংশধর সম্রাট “ভূমিবল অতুল্য তেজ”, যাকে নবম রাম বলা হয় ।
থাইল্যান্ডের সঙ্গে ভগবান রামের যোগসূত্র জানতে গেলে শ্রীরাম ও তাঁর বশধরদের জীবন জানা আবশ্যক । আর তা বর্ণিত আছে মহর্ষি বাল্মীকির মহান কাব্যগ্রন্থ রামায়নে । রামায়ন শুধুমাত্র ধর্মীয় গ্রন্থই নয়,এটি একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থও । ভগবান রামের সমসাময়িক কালের মহান ঋষি মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণের বলকান্ডের ৭০.৭১ এবং ৭৩ অধ্যায়ে ক্যান্টোস রাম এবং তাঁর তিন ভাইয়ের বিবাহের বর্ণনা করা হয়েছে ।
যার সারসংক্ষেপ হল : মিথিলার রাজা ছিলেন সিরধ্বজ, যাঁকে বিদেহাও বলা হত । তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল সুনেত্রা (সুনয়না), যাঁর কন্যা ছিলেন দেবী সীতা, যাঁর বিয়ে হয়েছিল শ্রীরামের সঙ্গে। রাজা জনকের কুশধ্বজ নামে এক ভাই ছিলেন। তাদের রাজধানী ছিল ইক্ষুমতি নদীর তীরে অবস্থিত সাংকাশ্য নগরীতে । তিনি তাঁর কন্যা উর্মিলাকে লক্ষ্মণের সঙ্গে, মান্ডভিকে ভরতের সঙ্গে এবং শ্রুতিকিতির সঙ্গে শত্রুঘ্নের বিয়ে দেন । ১৭১৫ সালে প্রকাশিত কেশব দাসের লেখা “রামচন্দ্রিকা” অনুসারে (পৃষ্ঠা ৩৫৪) রাম ও সীতার পুত্র লব এবং কুশ,লক্ষ্মণ ও ঊর্মিলার পুত্র অঙ্গদ এবং চন্দ্রকেতু,ভরত ও মান্ডবীর পুত্র পুষ্কর এবং তক্ষ এবং শত্রুঘ্ন ও শ্রুতিকীর্তির দুই পুত্র হলেন সুবাহু এবং শত্রুঘাত ।
ভগবান রামের পরবর্তী সময়ে তাঁর সাম্রাজ্যের পশ্চিমে লভপুর বা বর্তমানে লাহোরে লব,পূর্বে কুশাবতী কুশ, তক্ষক তক্ষশীলা, অঙ্গদকে অঙ্গদ নগর, চন্দ্রকেতুর চন্দ্রাবতী শাসনের ভার অর্পিত হয় । কুশ তার রাজ্য পূর্ব দিকে বিস্তৃত করেন এবং নাগ বংশের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। থাইল্যান্ডের রাজারা একই কুশের বংশধর। এই রাজবংশকে “চক্রী রাজবংশ” বলা হয়। যেহেতু রামকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং চক্র হল বিষ্ণুর অস্ত্র, তাই থাইল্যান্ডের রাজবংশের নাম লগ চক্রী রাজবংশ । থাইল্যান্ডের প্রত্যেক রাজাকে “রাম” উপাধি এবং নামের সাথে একটি সংখ্যা দেওয়া হয় । বর্তমানে যেমন নবম রাম ক্ষমতায় রয়েছেন, যার নাম “ভূমিবল অতুল্য তেজ”।
থাইল্যান্ডের অযোধ্যা:
থাইল্যান্ডের রাজধানীকে ইংরেজিতে ব্যাংকক বলা হয় । কিন্তু এর অফিসিয়াল নাম আকারে খুবই বড় । এমনকি এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নামের শহর বলেও পরিচিত । এর নামটি সংস্কৃত শব্দ দিয়ে তৈরি, দেবনাগরী লিপিতে পুরো নামটি নিম্নরূপ :-
“ক্রুং দেব মহানগর অমর রত্ন কোসিন্দ্র মহিন্দ্রায়ুধ্যা মহা তিলক ভব নবরত্ন রাজধানী পুরী রম্য উত্তম রাজ নিশান মহাস্থান অমর বিমান অবতার অবস্থিত শক্রদত্তিয়া বিষ্ণু কর্ম খ্যাতি”।
থাই ভাষায় এই পুরো নামে মোট ১৬৩ টি অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। এই নামের আরেকটি বিশেষত্ব আছে। নামটি বলা হয় গান গেয়ে। কেউ কেউ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য একে “মহেন্দ্র অযোধ্যা” বলেও ডাকেন। অর্থাৎ ইন্দ্র কর্তৃক নির্মিত মহান অযোধ্যা । থাইল্যান্ডের সমস্ত রাম (রাজা) এই অযোধ্যায় বাস করেছেন।
আসল রাম রাজ্য থাইল্যান্ডে কেন ?
বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, থাইল্যান্ডের লোকেরা তাদের রাজাকে বিষ্ণুর অবতার এবং রামের বংশধর বলে মনে করে, তাই, সেই হিসেবে থাইল্যান্ড রামরাজ্য । সেখানকার রাজাকে ভগবান শ্রী রামের বংশধর বলে মনে করা হয়। ১৯৩২ সালে থাইল্যান্ডে সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ভগবান রামের বংশধরদের কখনোই ব্যক্তিগত বা প্রকাশ্যে বিতর্ক বা সমালোচনার বৃত্তে আনা যায় না, তারা শ্রদ্ধেয় । থাই জনগণ তাদের শ্রদ্ধা জানাতে থাই রাজপরিবারের সদস্যদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, মাথা নত করতে হয়। রাজপরিবারের তিন কন্যার মধ্যে একজনকে হিন্দু ধর্মে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
থাইল্যান্ডের জাতীয় ধর্মগ্রন্থ কি ?
থাইল্যান্ডে থেরবাদ বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সেখানকার জাতীয় ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ। যাকে থাই ভাষায় “রাম কিয়েন” বলা হয়। যার অর্থ রাম কীর্তি, যা বাল্মীকি রামায়ণের উপর ভিত্তি করে লিখিত হয়েছে । এই পাঠ্যের মূল কপিটি ১৭৮৭ সালে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল । তাই চক্রী রাজা প্রথম রাম (১৭৩৬-১৮০৯) এটি পুনরায় লিখেছিলেন। থাইল্যান্ডে রামায়ণ হল জাতীয় গ্রন্থ । থাইল্যান্ডে, রাম কিয়েনের উপর ভিত্তি করে নাটক এবং পুতুল নাচের অনুষ্ঠান একটি ধর্মীয় কাজ বলে বিবেচিত হয়।
রাম কিয়ানের প্রধান চরিত্রগুলোর নাম নিম্নরূপ:-
১)রাম (রাম), ২)ভাগ্য (লক্ষ্মণ),৩)পালি (বালি), ৪) সুকৃপা (সুগ্রীব), ৫)অনকোট (অঙ্গদ), ৬)খোম্পুন (জামবন্ত), ৭)বিপেক (বিভীষণ), ৮)তোতাস কান (দশকন্ঠ) রাবণ, ৯)সদায়ু (জটায়ু), ১০) সুপন মাছ (শূর্পনখা), ১১) মারিত (মারিচ), ১২)ইন্দ্রচিত (ইন্দ্রজিৎ) মেঘনাদ, ১৩) ফ্রে পাই (বায়ুদেব) প্রভৃতি । থাই রাম কিয়েনে হনুমানের কন্যা এবং বিভীষণের স্ত্রীর নামও রয়েছে ।
থাইল্যান্ডের হিন্দু দেবদেবী:
থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং হিন্দু সংখ্যালঘু রয়েছে । তাসত্ত্বেও সেখানে কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি । থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরাও যে হিন্দু দেবতাদের পূজা করে তাদের নাম নিম্নরূপ :-১) ইসুয়ান (ঈশ্বন) ভগবান শিব, ২) নারাই (নারায়ণ) বিষ্ণু, ৩)ব্রহ্ম,৪)ইন (ইন্দ্র),৫)অথিত (আদিত্য) সূর্য এবং ৬)পায় (বায়ু) বায়ু।
গরুড় থাইল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক :-
গরুড় একটি বড় পাখি, যা প্রায় বিলুপ্ত। ইংরেজিতে একে ব্রাহ্মণী ঘুড়ি বলা হয়, এর বৈজ্ঞানিক নাম “হালিয়াস্তুর ইন্দু”। ফরাসি পক্ষীবিদ মাথুরিন জ্যাক ব্রিসন ১৭৬০ সালে এটি প্রথম দেখেছিলেন এবং দক্ষিণ ভারতের পন্ডিচেরি শহরের পাহাড়ে ঈগলটিকে দেখে এটির নাম দেন ( Falco indus)। ব্রাহ্মণ থেকে এই পাখির নাম এসেছে। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় ব্রাহ্মণ্য কাইট স্থানীয় নাম, তামিল হল ‘কৃষ্ণ পারুন্দু’। এটি হিন্দু দেবতা কৃষ্ণকে নির্দেশ করে। এই পাখিগুলোকে হিন্দুরা পবিত্র মনে করে ।
এটি প্রমাণ করে যে গরুড় কোন কাল্পনিক পাখি নয়। তাই ভারতীয় পৌরাণিক গ্রন্থে গরুড়কে বিষ্ণুর বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যেহেতু শ্রীরাম বিষ্ণুর অবতার, এবং থাইল্যান্ডের রাজা রামের বংশধর, তাই বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, হিন্দু ধর্মে অটল বিশ্বাস রয়েছে থাইল্যান্ডবাসীর । তাই এখানে ত “গরুড়”কে জাতীয় প্রতীক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে । এমনকি থাই পার্লামেন্টের সামনে গরুড়ের একটি প্রতিকৃতিও তৈরি করা হয়েছে।
সুবর্ণভূমি বিমান বন্দর:
থাইল্যান্ডের রাজধানীর বিমানবন্দরের নাম সুবর্ণভূমি। আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর। এর আয়তন ৫,৬৩,০০০ বর্গ মিটার। এর অভ্যর্থনা হলের ভিতরে রয়েছে সমুদ্র মন্থনের দৃশ্য। কিংবদন্তি অনুসারে, দেবতা এবং অসুর অমৃত আহরণের জন্য সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। দড়ির জন্য বাসুকি নাগ এবং মন্থনের জন্য মেরু পর্বত ব্যবহার করা হয়েছিল। সাপের ফণার দিকে অসুর এবং লেজের দিকে দেবতারা ধরে ছিল। মন্থন স্থিতিশীল রাখতে বিষ্ণু কচ্ছপের রূপে মেরু পর্বতের নিচে অবস্থান করেন । বিমানবন্দরের ভিতরে এই অনন্য চিত্র দেখে যে কেউ বিমোহিত হয়ে যায় ।
থাইল্যান্ড সনাতনি ঐতিহ্যকে যুগ যুগ ধরে আঁকড়ে থাকলেও ভারত থেকে ওই ঐতিহ্যকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বারবার । প্রথমে মুঘল হানাদার, পরে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ এবং স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের শাসনে সাংবিধানিক ভাবে দেশকে সেকুলার সাজিয়ে ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে । দেশের অনেক শহরের নামকরণ করা হয়েছে মুসলিম আক্রমণকারী বা সম্রাটদের নামে। রাজধানী দিল্লির প্রধান সড়কগুলোর নাম পর্যন্ত মুঘল শাসকদের নামে করেছিল কংগ্রেস সরকার । মুঘল হানাদার বাবর দ্বারা অযোধ্যার সুপ্রাচীন রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মান করা হয়েছিল । বাবরি মসজিদকে রক্ষার জন্যেও আড়ালে থেকে লড়াই করতে দেখা গিয়েছিল ভারতের প্রাচীন ওই রাজনৈতিক দল ও ভারতের তথাকথিত সেকুলার কমিউনিস্টরা ।।