সৃষ্টি ও ধ্বংসের রহস্য উপলব্ধি করার জন্য আমরা আটজন বন্ধু বেরিয়ে পড়েছিলাম কেদারনাথের উদ্দেশ্যে। আমাদের গাড়ি তখন গৌরীকুন্ডে পৌঁছেছে সবে। প্রায় সন্ধ্যে, হালকা বৃষ্টি ও শীতল আবহাওয়ার মধ্যে বন্যতার প্রাকৃতিক প্রেম। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকের সাথে শীতল জলস্রোতের শব্দ কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।
অনিমা বলে উঠল- মন্দাকিনীর জলপ্রবাহ। ওদের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে অর্ধেক দিন ফ্যানের মধ্যে গুটি কয়েক ভাত খেয়ে পেট ভরায় সকলে। নেহাত মহিমা ওর ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করেছিল বলেই ওর আসতে পেরেছে।
যাইহোক আমাদের আট বন্ধুর এই প্রথম এমন ট্রেকিংয়ে আসা। ওই রাতে আমরা ছিলাম ছোট্ট একটা খুপড়ির মতো ঘরে। খুব অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে একটা গাইড পেয়েছিলাম। আসলে এই গাইড নিজেই আমাদের কাছে আসে।
সময়টা ছিল আগস্টের শেষ, সেপ্টেম্বরের শুরু। মোটামুটি ভালই শীত। কুয়াশা ভেদ করার জন্য সূর্যদেব আকাশে কিছুটা উসখুস করছিল। তখনো আমরা ভাবতে পারিনি কী ঘটতে চলেছে আমাদের সকলের জীবনে!
কুয়াশা, জল, কাদা ঘেরা পথের ধাপে ধাপে মন্দাকিনী রূপ দেখতে দেখতে আমরা হেঁটে চলেছিলাম। গাইড মন্দাকিনীর কথা বলতে বলতে ধৌলিগঙ্গার প্রসঙ্গে আসে।
… ২০১৩ সাল। মন্দাকিনীর জলপ্রবাহে মানুষ, ঘরবাড়ি,গাছপালা, পশুপাখি আবর্জনার মতো ভেসে গিয়েছিল। শুধুমাত্র কেদারনাথের মন্দিরটি অক্ষত ছিল। এই অঞ্চলে যখন তখন আবহাওয়ার বিরূপ আকার ধারণ করে। তখন প্রকৃতির অবস্থা খারাপ হয়। ভূমিধ্বস পর্যন্ত হয়ে যায়। বিদ্যুৎ চলে যায় যখন তখন।
আচ্ছা, চুপ করুন। কেন বলছেন এসব কথা? – বলে উঠল গরিমা। আমাদের মনকে দুর্বল করবেন না।
আমি গরিমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বললাম – চুপ কর। এত কম খরচে গাইড আর পাওয়া যাবে না। ওর কথা কানে না নিলেই হলো।
একটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ হেঁটে চলেছি আমরা। একটু এগোলেই জঙ্গলের একটা চটিতে ওঠা যাবে। সেখানে পৌঁছতে পারলেই একটু চা বিস্কুট খেয়ে হালকা বিশ্রাম নেয়া যাবে।
এখানে প্রকৃতি পাহাড়ি পথ। বহু যুগ ধরে জঙ্গলের বন্যতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলেছে। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যে হব হব। সূর্যদেব গোধূলির থেকে আবির নিয়ে প্রকৃতিকে তিলক কেটে দিয়েছে। এমন সময় গরিমা ‘বাবা গো’ বলে আর্তনাদ করে উঠল। দেখা গেল একটি পাথরের ফাঁকে ওর পা আটকে গেছে। আমরা বন্ধুরা প্রচুর চেষ্টা করেও সরাতে পারলাম না। এই ঠান্ডাতেও আমাদের কপাল ও শরীর থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। আমাদের গাইড তার ব্যাগ থেকে রডের মত দেখতে একটি লোহার খণ্ড বের করে পাথরের খন্ডটির নিচে অদ্ভুত কায়দায় ধরতেই পাথরটি একটু সরলো। কিন্তু তার ফাঁক দিয়ে ব্যাগ নিয়ে আমাদের ওপারে যাওয়া দুরূহ হলো। গাইড কি সব বিড় বিড় করতে করতে নিজের ব্যাগটি পাথরের ফাঁক দিয়ে আগে ওপারে ফেলে। তারপর নিজে শরীরকে কাত করে ওই ফাঁক দিয়ে পাথরটিকে অতিক্রম করলো। ওকে দেখে আমরাও একে একে নিজেদের হালকা করে পাথর পারাপার করলাম। লঘিমার এত ঘাম ঝরল যে সে তো হাঁপিয়ে নিজেকে একাকার করলো।
এই গলদঘর্মের মধ্যে প্রকৃতির শীতল ছোঁয়া কপালে লাগতেই ঘাম শুকাতে লাগল। এ যেন এক মাতৃসুলভ অনুভূতি! প্রকৃতি মায়ের আধ্যাত্মিক স্নেহের পরশ। এভাবেই আমরা রামওয়াড়াকে পেলাম। চা, বিস্কুট, ছোলা সেদ্ধ খেতে খেতে মন্দাকিনীর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। জীবনের নৈসর্গিক প্রাপ্তি। মন্দাকিনীর কিশোরী সবুজাভ নীল জলধারা মিশে যায় অলকানন্দার সাথে। এই কিশোরীর চলার পথ ধরেই সন্ধান মেলে ভোলানাথের। যেন স্বয়ং প্রকৃতি পুরুষের সন্ধান দিয়ে চলেছেন এইভাবে।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার শেষে রাত নেমে এলো। আমাদের গাইড ম্যাগি, ছোলা সেদ্ধ আনলেন। আমাদের শরীর তখনো বেশ ক্লান্ত। পরের দিন সকালে ফের হাঁটব। সেই রাত কাটানোর জন্যে ছোট্ট চটির মধ্যে আশ্রয় নিলাম। ক্লান্ত শরীর ও মনের মধ্যে হরিদ্বার থেকে শুরু করে অলকানন্দা, মন্দাকিনীর রেশ, হিমালয়ের বড় ছোট ঝর্ণা- সব মিলেমিশে ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনিতে ভরপুর হতে লাগলো। জীবনের প্রথম হিমালয় যাত্রা। শিবকে একটু দেখবার আকুল ইচ্ছে। আমার সঙ্গীরা তখন শান্ত,নিদ্রিত।
মনের মধ্যে চলেছে বহু কিছুর আসা-যাওয়া। জীবনের কত কথা, প্রশ্ন, আবেগ- কোনটা আগে বলব বাবার কাছে তার হিসেব-নিকেশ করতে করতে কখন যে চোখ জুড়িয়ে এলো জানি না। ভোর হতেই দূর থেকে ঘোড়ার পায়ের ক্ষুরের শব্দের সাথে কানে আসতে লাগলো ‘জয় কেদারনাথ’, ‘জয় কেদারনাথ’ ধ্বনি। আমি উঠে চোখ মুখ ধুয়ে গাইডকে ডাকতে যাব এমন সময়ে দেখি সে নিজের হাতে গরম চা বিস্কুট নিয়ে হাজির। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই শরীরের ক্লান্তি যেন অনেকটা হঠাৎ করে এনার্জি পেল। এত সকালে সে চা পেল কিভাবে? তা আর জিজ্ঞাসা না করেই লাঠি আর পিঠের ব্যাগ নিয়ে উঠলাম বাবার ধামে। ওদিকে মন্দাকিনী তখন এগিয়ে চলেছে নাচতে নাচতে গৌরীকুন্ডের দিকে। প্রকম্য বলে উঠল- ও এখন দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে চলেছে, ওসব ভাবিস না। চল আমরাও এগিয়ে চলি।
গাইডকে অনুসরণ করে বাবাকে ভেবে এগিয়ে চলেছি। প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের জাদুরাশি জাল বিস্তার করেছে। গড়ুরচটি থেকে সামান্য পথ ঘুরলেই বাবা কেদারনাথের মন্দির যাওয়ার রাস্তা। ভূমিরূপ কিছুটা সমতল। একটা পুল রয়েছে মন্দাকিনীর উপরে। এক পাশ থেকে নেমে গেছে দুধগঙ্গা। যতই এগিয়ে চলেছি আগের পথ চলা প্রকৃতির সাথে এর তুলনা করা যায় না। এখানে প্রকৃতি ক্ষণে ক্ষণে নিজের রূপ পাল্টায়। সে রূপের মধ্যে শরীরের ক্লান্তি কখন কোথায়, মাঝেমধ্যে বোঝা যায় না। গাইড কোথায়, কত আগে বা পরে তাও মনের অনুভূতিতে নেই। নৈসর্গিক প্রকৃতির কাছে আমি তখন ‘আপন ভোলা’ শিশু। হাঁ করে চারিদিকে দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছি। হঠাৎ ঈশিতা কাঁধে হাত রাখতেই নিজের সঙ্গীদের অবস্থান উপলব্ধি করতে পারলাম।
আমাদের গাইড একটু দূর থেকে বলে উঠলো- আর আট- নয় কিলোমিটারের মতো রাস্তা। চারিদিক থেকে ‘জয় কেদারনাথ’ ‘জয় কেদারনাথ’ ধ্বনির সাথে ডমরু ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মনে হতে লাগলো ১১-১২ কিলোমিটার তো হাঁটা হয়ে গেল। আর মাত্র ৯ কিলোমিটারের মতো। শঙ্খ ধ্বনি কানে আসতে লাগলো। সাথে ধূপের গন্ধ । শঙ্খের ধ্বনিতে দুচোখ গেল খুলে। চোখ খুলতেই কেমন একটা হতচকিত হয়ে গেলাম। খুঁজতে লাগলাম কেদারনাথকে।
দেখলাম মা ঘরের মধ্যে সোমবারের পুজো শেষ করে শাঁখ বাজাচ্ছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন- কি রে আজ স্কুলে যাবি না? আজ গণেশ চতুর্থী, তোর কি স্কুলের ছুটি আছে?
আমি বললাম- না, গণেশ চতুর্থীতে কেনো ছুটি থাকবে? ঘরে ঠাকুর রাখা সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগলোএতক্ষণ যাদের দেখলাম তারা কারা তনিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রকম্য,ঈশিতা এরাই বা কোথা থেকে এলো? গাইড বশিতাই বা কে? আমার কি কোন দিন বাস্তবে এদের সাথে দেখা হবে। এরা ২০১৩ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারিয়ে যায়নি তো! কি জানি জানা নেই। এই ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গী সাথীরা কারা। কিভাবে এরা এলেন। কেমন একটা আধো ঘুমের ঘোরে মন বলে উঠল- আজ গনেশ চতুর্থী। এর উত্তর কি অষ্টসিদ্ধি গনেশজীর জানা ?