পতিতালয়ে বড় হওয়া ঝিলমিলকে কখনও কারোর রাতের সঙ্গিনী হতে হয়নি, সৌজন্যে বিমলা মাসি। ঝিলমিলের জন্মের পরপরই ওর মা সাথী মারা যায় দশ দিনের জ্বরে। সেই থেকেই বিমলা ওকে আগলে রেখেছে চারপাশের নর রাক্ষসদের হাত থেকে।
-‘মাসি আজকে চয়ন আসবে।’
-‘ হ্যাঁ রে মনা ও সব সত্যি জানে!’
-‘ মাসি আমার সবটুকু ওর কাছে খোলা বইয়ের পাতার মতো।’
-‘ যাক বাবা ও যে তোর শিক্ষার গুণে মোহিত হয়ে তোকে চিরজীবনের মত নিজের করতে চায় এর জন্যে ভগবানকে শত কোটি প্রণাম।’
ঝিলমিল অঙ্কে পি.এইচ.ডি করে একসঙ্গে চয়নের সাথেই গবেষণা করছে। চয়নের পরিবার এ সম্পর্ক মেনে নেয়নি। হয়ত সমাজের মূল স্রোতে মিশতে এখনও অনেক সময় লাগবে ঝিলমিলদের মত পতিতালয়ের তকমা পাওয়া নারীদের। তা সে যতই শিক্ষিত হোক না কেন!
চয়নের সঙ্গে ঝিলমিলের বিয়ে হয় এক শুভ মুহূর্তে। সেদিন ছিল জন্মাষ্টমী। রেজিষ্ট্রি পেপারে সই করে, তারপর মালাবদল ও সিঁদুর দান। পাশে বিমলা ও চয়নের দিক থেকে ছিল ওর দুই বন্ধু কৌশিক ও অভীক।
-‘ বাবা চয়ন, মনা আমার প্রাণ। ওকে সুখে রেখো। ওকে পতিতালয়ের অন্ধকারে মিশে যেতে দিইনি। কারণ আমি সম্পর্কে ওর যশোদা মা। তাই প্রাণপণে ওকে লালন পালন করেছি।’
-‘ মাসি আমি ওকে আগলে রাখবো।’
চয়নের সাথে ওর ভাড়া বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল ঝিলমিল। পিছনে ফিরে তাকাতে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, বিমলা মাসির চোখে জল। ওরও বুক ফাটছে। কিন্তু ওই দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে ওকে বের হতেই হতো। তবুও সম্পর্কের মায়া কী এত সহজে এড়ানো যায়!
সেদিন রাতে,
-‘ তোমার বিমলা মাসি ফোন করেছিলেন আমাকে।’
-‘ সে কি চয়ন! আমাকে কেন ফোন করেনি!’
-‘ কিছু টাকা দরকার ওনার, কিন্তু আমি সোজাসুজি জানিয়ে দিলাম সম্ভব নয়। আমাদের স্টাইপেন্ডের টাকায় নিজেদেরই দম বেরিয়ে যাবার জোগাড় হচ্ছে!’
-‘ চয়ন! তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো? বিমলা মাসি.. উনি আমার যশোদা মা। তুমি এভাবে ওনাকে বলতে পারলে?’
-‘ দেখো তোমাকে বিয়ে করতে নিজের বাবা, মা এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি আর তুমি কিনা…’
-‘ তুমি কি অনুতপ্ত চয়ন!’
-‘ না তা বলছি না। তবে তুমি এবারে বিমলা মাসিকে ভুলে যাবার চেষ্টা করো।’
ঝিলমিল স্তম্ভিত!
প্রায় দিন দশেক পর ,
চয়ন বিমলা মাসির সঙ্গে দেখা করতে গেলো কারণ ওকে বিমলা ফোন করেছিল।
বিমলা শয্যাশায়ী। চয়নের এই নোংরা এলাকায় আসতে গা গুলোয়। ও ভদ্র পরিবারের তো!
-‘ ও বাবা তুমি এসেছো। বসো। সেদিন তুমি ঝিলমিলকে দিয়ে দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছো জেনে মনটা খুশিতে ভরে গিয়েছিল। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি আমি মনাকে। আমি জানি ও সঠিক মানুষ নির্বাচন করবেই। ‘
চয়ন বেশ অবাক, বারণ সত্ত্বেও ঝিলমিল আবার এখানে এসেছিল!
-‘ বিমলা মাসি আপনি কেমন মানুষ বলুন তো! এখনও ঝিলমিলের সংসারে নাক গলাচ্ছেন!’
-‘ বাবা চয়ন তুমি কী পছন্দ করো না! যে ঝিলমিল এখানে আসুক!’
-‘ আমি নিজেই আসতে চাই না, আবার ঝিলমিল! ও আমাকে না জানিয়ে এখানে এসেছিল সেটাই ভাবতে অবাক লাগছে!’
-‘ ঠিক আছে বাবা আমি কথা দিলাম আজকের পর থেকে তোমাদের দুজনকেই আর এখানে আসতে হবে না।’
-‘ এটাই ভবিষ্যতের জন্যে সঠিক হবে।’
কথা শেষেই চয়ন বিমলার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
প্রায় দিন দশেক হয়ে গেল। ঝিলমিল বিমলা মাসির কোনো খবর পাচ্ছে না। ফোনটা সুইচড্ ওফ বলছে। ও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। কিন্তু চয়নকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। ও যেন সম্পর্কের উভয় সংকটে উপনীত। তবুও ও যাবে বিমলা মাসির কাছে আজ।
সকালের রোদ্দুর মেখে রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে বড্ড মন কেমন করছে ঝিলমিলের বিমলার জন্য।
ও বিমলার ঘরের দিকে এগোতে যাবে এমন সময় অনিতা পিছন থেকে ঝিলমিলকে ডাক দেয়।
-‘ কোথায় যাচ্ছিস? ঠিক সময়ে তো আসলি না। আচ্ছা বেইমান মেয়ে তুই..’
-‘ মানে কি বলছো অনিতাদি ! আমি কী বেইমানি করলাম!’
-‘ বিমলা গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে পাঁচ দিন আগেই। তোকে ফোন করেছিলাম তোর বর ফোনে জানায় তুই আসতে পারবি না। আর ও তোকে কোনো নোংরা পুলিশি ব্যাপারে জড়াতে দেবে না।’
ঝিলমিলের চোখে জল বাগ মানছে না। ও আর ওখানে না দাঁড়িয়ে সোজা বাড়ির পথে হাঁটা দিল।
-‘ চয়ন, অনিতাদি তোমাকে ফোন করেছিল! বিমলা মাসির মৃত্যুর খবর দিতে! তার মানে তুমি ফোন রিসিভ করে নম্বরটা আমার ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়েছিলে! ছিঃ তুমি কি মানুষ!’
-‘ বেশ করেছি তোমাকে না জানিয়ে , আর আপদটা মরেছে বেশ হয়েছে।’
-‘ চয়ন উনি আমার যশোদা মা।’
-‘ হ্যাঁ তুমি পতিতার মেয়ের সম্মানে দেখছি বেশি কমফোর্টটেবল।’
ঝিলমিল আর কথা বাড়ায় না।
রাত বেশ গভীর ঝিলমিল শেষ বারের মত চয়নের দিকে তাকিয়ে বাড়ি ছাড়লো নিরুদ্দেশের পথে।
ওর মন ভিজে যাচ্ছে কান্নায়। চয়ন বোধহয় আজ ওকে ওর জীবনের চরম দিকটা দেখিয়ে দিল, ও পতিতার মেয়ে। যা এই দীর্ঘ চলার পথে বিমলাদেবী ওকে এক মুহুর্তের জন্যেও অনুভব করাননি। একেই বলে বোধহয় মাতৃত্বের সম্পর্ক। যা পৃথিবীর সব সম্পর্কের উপরে।।