জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বাঁকুড়া,২০ জানুয়ারী :
লোকাল ট্রেনে চেপেছে অথচ মশলা মুড়ি খায়নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন! অথবা সন্ধ্যার সময় পরিবারের সদস্যদের বা বন্ধুদের সঙ্গে বসে চপ, পেঁয়াজি, বেগুনি বা চানাচুর মাখিয়ে এবং সঙ্গে পেঁয়াজ ও শশা কুচি দিয়ে মুড়ি খাওয়ার স্বাদই আলাদা। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলা যায় – এ স্বাদের ভাগ হয়না। পিকনিকের সময় টিফিনের আইটেম হিসাবে থাকে মুড়ি। মাঝে মাঝে শুধু মুড়ি ফিস্টও হয়। কিন্তু তাই বলে ‘মুড়ি মেলা’ এবং তাকে কেন্দ্র করে সমস্ত বয়সী মানুষের ভিড় সম্পূর্ণ অকল্পনীয়। অথচ প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঁকুড়ার সদর থানার অন্তর্গত কেঞ্জাকুড়া গ্রামের নিকটবর্তী দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে এই ‘মুড়ি মেলা’ চলে আসছে।
কেঞ্জাকুড়া সহ আশেপাশের গ্রামের মানুষের বিশ্বাস গ্রাম দেবতা সঞ্জীবনী মাতা এখানে দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে বাস করেন। তাকে কেন্দ্র করেই এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর এই সঞ্জীবনী মাতার আশ্রমে মকর সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু হয় হরিনাম সংকীর্তন। ভক্তদের ভিড় বাড়ে। সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় ৪ঠা মাঘ। চলতি বছরেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৪ ঠা মাঘ সকাল থেকে কেঞ্জাকুড়া সহ পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে প্রায় ৫০-৬০ হাজার মানুষ নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এই ‘মুড়ি মেলা’য় এসে উপস্থিত হন।কোথাও আবার বন্ধুদের ভিড় দেখা যায়। তারপর নদীর চরে গামছা পেতে তাতে মুড়ি রেখে চপ, সিঙ্গাড়া, চানাচুর, লঙ্কা, শশা, পেঁয়াজ, টম্যেটো, ধনেপাতা, নারকেল সহ বিভিন্ন উপাচার ও নদীর চরে তৈরি ‘চুয়া’ থেকে বের হওয়া জল দিয়ে মাখিয়ে পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলে গামছার উপরে খাওয়া শুরু করে। এক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের কোনো পার্থক্য নাই। দুপুরে মেলা কমিটির পক্ষ থেকে মেলায় আসা মানুষদের জন্য খিচুড়ি প্রসাদ খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি বসে সেই প্রসাদ খাওয়ার তাৎপর্য আলাদা। যুগের পরিবর্তন হলেও সেই রীতি আজও চলে আসছে। পরিবর্তন শুধু একটাই এখন অন্য জেলার বাসিন্দারা এই ‘মুড়ি মেলা’র স্বাদ নিতে চলে আসে।
স্থানীয় বাসিন্দা সাধন কুমার কর্মকারের কাছে শোনা গেল এই মেলার ইতিহাস। সবই তিনি তার বাপ-ঠাকুরদার কাছে শুনেছেন। তিনি বললেন, ‘বহুদিন আগে স্থানীয় এক জমিদার বাড়ির সন্তান অল্প বয়সেই সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন পর গ্রামে ফিরে এলেও নিজের বাড়িতে বসবাস করতে তার মন চায়নি। গ্রামবাসীরা দ্বারকেশ্বরের তীরে নিম গাছের নীচে তার থাকার জন্য একটি কুটির নির্মাণ করে দেয়। সেখানেই তিনি সাধনা করতেন। গড়ে ওঠে সঞ্জীবনী মাতার মন্দির। তার টানে ভক্তরা সেখানে হরিনাম শুনতে আসতেন। ঘন জঙ্গলের হিংস্র জীবজন্তুর ভয়ে রাতে তারা বাড়ি ফিরতে পারতেন না। ফলে রাতে তারা দ্বারকেশ্বরের জলে নিজেদের সঙ্গে আনা মুড়ি ভিজিয়ে খেতেন। সেই থেকেই শুরু হয় ‘মুড়ি মেলা’ যা আজও চলে আসছে। প্রথম দিন থেকে ভিড় হলেও প্রচারের আলোয় আসার পর সেই ভিড় আজ কার্যত জন সমুদ্রে পরিণত হয়েছে।’
বিষ্ণুপুরের একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষিকা মেদিনীপুরের মৌমিতা ঘোষাল বললেন,’পড়াশোনার জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছি। বন্ধুদের কাছে অবাক হয়ে ‘মুড়ি মেলা’-র কথা শুনতাম। এবারই প্রথম এলাম। তারা যে বাড়িয়ে বলেনি এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুডে আসক্ত বর্তমান প্রজন্মের ভিড় দেখে বিস্মিত হয়েছি।’তার মত স্থানীয়দের বিশ্বাস শত পরিবর্তনের মধ্যেও আগামী দিনেও গ্রামীণ এই ঐতিহ্য বজায় থেকে যাবে।।