প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৮ জানুয়ারী : বাংলা সাহিত্যে চির অমর হয়ে রয়েছে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘দেবদাস’ উপন্যাস।সেই উপন্যাসের দেবদাস মিষ্টান্নের ভক্ত ছিলেন কিনা ,তা অবশ্য আজও কারুর জানা যায় নেই। তবে ’দেবদাস’ উপন্যাস কে আঁকড়ে পূর্ব বর্ধমানের কালনার ’হাতিপোতা’ গ্রাম চলা দেবদাস স্মৃতি মেলা প্রাঙ্গন শুধুই যেন মিষ্টি ময় । তাও আবার যে সে মিষ্টি নয়। পাঁচশো টাকা থেকে শুরু করে দু’হাজার টাকা পিস দরের এক একটা পেল্লাই মিষ্টি সেই মেলায় বিক্রি হচ্ছে । যার স্বাদ নিতে বহু মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে মেলা প্রাঙ্গনে।আর কঠিন ঠাণ্ডার মধ্যেও বিক্রি বাটা ভালো হওয়ায় দেবদাসের নামে জয়ধ্বনিও দিচ্ছেন মিষ্টান্ন কারবারিরা।
’হাতিপোতা’ গ্রামটি পূর্ব বর্ধমানের জেলার কালনা-১ ব্লকের নান্দাই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অবস্থিত। এলাকার মানুষেজন মনে করেন,’কথাসাহাত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই ’হাতিপোতা’ গ্রামথেকেই দেবদাস উপন্যাস লেখার রসদ খুঁজে পেয়েছিলেন’
।সেই বিশ্বাসে ভরকরেই ’দেবদাস’ কে চিরস্মরণীয় করে রাখতে হাতিপোতা গ্রামের মানুষজন প্রতি বছরই ‘দেবদাস স্মৃতি মেলা ’ও উৎসবের আয়োজন করে থাকেন।এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয় নি ।শরৎচন্দ্রের ছবিতে মালা পরিয়ে ও প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্যদিয়ে মঙ্গলবার থেকে হাতিপোতা গ্রামে শুরু হয়েছে ২৪ তম বর্ষের ’দেবদাস স্মৃতি মেলা’। আগামী ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত মেলা চলবে। আয়োজকরা জানিয়েছেন দেবদাস স্মৃতি মেলা ঘিরেই এখন মাতোয়ারা গোটা হাতিপোতা গ্রাম।
উৎসব আয়োজকদের পক্ষে রেজাউল মোল্লা , বুধবার জানান ,কথাসাহিত্যিকের ‘দেবদাস’ উপন্যাসে অন্তিম অনুরোধ ছিল-“তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও ”। সেই প্রার্থনাতে সাড়া দিয়েই তাঁরা প্রতিবছর উপন্যাসিকের ’প্রয়াণ’ দিবসের দিনটিকে স্নরণ করে দেবদাস স্মৃতি মেলা ও উৎসবের আয়োজন করে থাকেন।রেজাউলের কথা অনুযায়ী ,’উপন্যাসে উল্লিখিত জমিদার বাড়ির সব স্মৃতি আজ আর সম্পূর্ণ রুপে না থাকলেও আংশিক কিছুটা রয়ে আছে।সেই টানেই সাহিত্য প্রেমী ও পর্যটকরা আজও হাতিপোতা গ্রামে আসেন।তারই পরিপ্রেক্ষিতে হাতিপোতা গ্রাম এখন রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রেও জায়গা করে নিয়েছে।
হাতিপোতা গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দাদের কথায় জানা গেল,একদা হাতিপোতা গ্রামের প্রাক্তন জমিদার ছিলেন ভুবনমোহন চৌধুরী। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী তালসোনাপুরের ‘পার্বতী-ই’ ছিলেন দেবদাস উপন্যাসের নায়িকা“।প্রবীনরা এও জানান,
উপন্যাসের একাংশে উল্লেখ রয়েছে,“পার্বতীর পিতা কাল বাটি ফিরিয়াছেন।এই কয় দিন তিনি পাত্র স্থির করিতে বাহিরে গিয়াছিলেন’।প্রবীনরা বিশ্বাস করেন,বর্ধমান জেলার হাতিপোতা গ্রামের জমিদারই সেই পাত্র । উপন্যাসের কাহিনীর এক অংশে হাতিপোতা গ্রামের নাম প্রকাশ পেয়েছে ।তাই বাস্তবের হাতিপোতা গ্রামের মানুষজন আজও মনে করেন ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে শরৎচন্দ্র নিজেই নদীপথে তাঁদের গ্রামেই এসেছিলেন।উৎসব কমিটির অপর সদস্য আবজেদ সেখ জানান,কথা সাহিত্যিকের ’দেবদাস’ উপন্যাসের দৌলতেই ধন্য হয়েছে তাঁদের হাতিপোতা গ্রাম। বেড়েছে হাতিপোতা গ্রামের গুরুত্ব“। রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন,দেবদাস উপন্যাসের দৌলতেই আজ হাতিপোতা গ্রামের নাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় ।কথা শিল্পীর উপন্যাস-ই এই গ্রামকে ধন্য করেছে ।
এ তো না হয় গেল দেবদাস উপন্যাকে আঁকড়ে মেলা ও উৎসব আয়োজনের ইতিবৃত্ত।কিন্তু এটা হয়তো অনেকেই জানেন না,যে দেবদাস মেলা প্রাঙ্গনে মিষ্টান্ন কারবারীদের পেল্লাই সাইজের মিষ্টান্ন তৈরি করে বিক্রীর পিছনে রয়েছে এক অভিনব ভাবন। এ নিয়ে মিষ্টান্ন কারবারীদের বক্তব্য ,“দেবদাস উপন্যাসের ন্যায় বিখ্যাত কিছু একটা করে দেখানোর ভাবনা নিয়েই তাঁরা ’পেল্লাই মিষ্টি’ তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেন“।নদীয়া থেকে এসে মেলায় মিষ্টির দোকান খুলে বসা আকবর আলী শেখ জানান,“ ছানার সঙ্গে ময়দা ও অন্যান উপকরণ একসাথে মিশিয়ে তা ভালকরে মেখে তাঁরা ছোট সাইজ থেকে শুরু করে পেল্লাই সাইজের নানা ধরণের মিষ্টি তৈরী করছেন। তার মধ্যে খরিদ্দারের কাছে নজর কেড়েছে পেল্লাই সাইজের ’নোড়া পান্তুয়া’। সাইজ অনুযায়ী সেইসব মিষ্টির কোনটির দাম পাঁচশো ,কোনটি হাজার আবার কোনটির দু-হাজার টাকা রাখা হয়েছে।আকবর আলির জানান,“দু-হাজার টাকা দামের একটা মিষ্টি তৈরী করতে তাঁদের প্রায় ৪ কিলো ছানা লাগে ।তার সঙ্গে থাকে ময়দা সহ অন্যান্য উপকরণ।রসে ডোবানোর পর ওই একটি মিষ্টির ওজন প্রায় সাত কেজিতে গিয়ে দাঁড়ায়’। কিন্তু তাতে কি যায় আসে । আকবর আলির দাবি “দাম এত বেশী হলেও স্বাদে ও আকারে চমকপ্রদ অমন মিষ্টি অন্য কোথাও তেমন বিক্রী হয় না । ত তাই দেবদাস মেলায় ওই পেল্লাই সাইজের মিষ্টি দেদার বিক্রী হচ্ছেে ।
অপর মিষ্টান্ন কারবারী লালন শেখ জানালেন,পাঁচ দিনের দেবদাস মেলায় তাঁদের দোকান থেকেও দু’হাজার টাকা দামের মিষ্টি ভালোই বিক্রি হচ্ছে।শুধু তাই নয় । লালনের দাবি,“এমন মিষ্টি দেখতেও দূরদূরান্তের অনেক মানুষ তাঁদের দোকানে ভিড় করছেন। এমনকি বিদেশে থাকা পরিজনদের জন্য এমন মিষ্টি নিয়ে যাবেন বলে অনেকে মেলেয় এসে তাঁকে অর্ডারও দিয়ে গেছেন ।।