প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৫ জানুয়ারী : কথায় আছে ’ঢেঁকি’ স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে । তবে সেই সবই এখন গল্পকথা।ইদানিং কালে আবার যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে চলায় ঢেঁকির কদর অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে।তবুও এই রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের কিছু মানুষ সাবেকি ঢেঁকিকে এখনও আগলে রেখেছেন। পৌষমাস শুরু হলে পিঠে-পুলির চাল কোটার জন্যে সেই সাবেকি ঢেঁকির কদর বেড়ে যায় । তা থেকে তখন একটু হলেও আয়ের পথ খুঁজে পান গ্রামের মহিলারা। যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে রাজ্যের শস্যগোলা বলে পরিচিত পূর্ব বর্ধমানে।এই জেলার রায়না ,খণ্ডঘোষ ও জামালপুর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম গুলির মহিলারা পৌষ পার্বণে সদাব্যস্ত ঢেঁকিতে চাল কোটার কাজে।পৌষের সংক্রান্তির লগ্নে ওই সব গ্রাম গুলিতে এখন কান পাতলেই শুধু ভেসে আসছে ঢেঁকিতে চাল কোটার শব্দ ।
এক সময় পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে গ্রাম বাংলার মহিলারা ঘরে ঘরে ঢেঁকিতে চাল কোটা শুরু করে দিতেন। ঢেঁকিতে ভাঙা চাল গুঁড়িয়ে তা দিয়েই তাঁরা তৈরি করতেন হরেক রকমের পিঠে-পুলি।কিন্তু যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধির ধাক্কায় ঢেঁকি এখন যেন মিউজিয়ামে জায়গা করেনিতে বসেছে ।ঢেঁকি ছেড়ে গ্রাম বাংলার অনেক মানুষ এখন চাল গুঁড়ানোর মিলে পৌছে যাচ্ছেন। তবে তারই মধ্যে বেশ কিছু গ্রামের মানুষ এখনও ’ট্র্যাডিশন’ বজায় রেখে বাড়ির সাবেকি ঢেঁকিকে আগলে রেখেছেন।যেমনটা আগলে রেখেছেন জামালপুরের শিয়ালী ও কোড়া গ্রামের মানুষজন। তাঁরা চান না গম ভাঙানোর যন্ত্রে পিঠে-পুলির চালের গুঁড়ো তৈরি করতে ।শিয়ালী ও কোড়া গ্রামের মহিলারা প্রতিবছরের ন্যায় এই বছরও তাই ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের গুঁড়ো দিয়ে পৌষ পার্বণে পিঠে-পুলি তৈরি করে পরিবারের সকলকে তৃপ্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি নিজেদের ঢেঁকিতে অপরের চাল গুঁড়িয়ে দিয়ে সামান্য কিছু হলেও উপার্জন করছেন ।
গ্রামের বধূ কাকলী কোলে জানান,ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের গুঁড়ি দিয়ে বানানো পিঠে- পুলির স্বাদটাই আলাদা। আর ঢেঁকিতে ছাঁটা চাল অনেকদিন ধরে রেখেও দেওয়া যায় । অপর বধূ কল্পনা কোলে বলেন,’আমাদের শিয়ালী গ্রামে এখন একটি মাত্রই ঢেঁকি রয়েছে। পৌষ পার্বণের আগে সেই ঢেঁকিতে চাল ভাঙাতে আসেন গ্রামের অনেক মহিলা। উপার্জনের আশায় পৌষে ঢেঁকিতে চাল ভাঙানোর কাজে ঢেঁকির মালিক পরিবারের পুরুষরাও মহিলাদের সঙ্গে হাত লাগান ।’ খেজুর গুড়ের সঙ্গে ঢেঁকিতে গুঁড়ো করা চাল দিয়ে তৈরি পিঠে-পুলি আগামী কটা দিন বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে এক ভিন্য মহিমায় পৌছে দেয় বলে মনে করেন শিয়ালী ও কোড়া গ্রামের মহিলারা ।
শিয়ালী ও কোড়া গ্রামে রবিবার গিয়ে দেখা যায় গ্রামের এক প্রান্তে মাটির দাওয়ায় বসে ঢেঁকিতে
চাল গুঁড়ানোর কাজ করে চলেছেন মহিলা ও পুরুষরা ।যন্ত্র ও স্মার্ট ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির যুগে সত্যি যেন এটা একটা বিরল দৃশ্য হিসাবেই সামনে আসে ।এমনটা দেখে কারুরই বুঝতে অসুবিধা হবে না,যে গ্রাম বাংলার কিছু মানুষজনের দৌলতে কাঠের তৈরি ঢেঁকি গ্রামবাংলা থেকে এখনও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তাই শিয়ালী ও কোড়া গ্রামের রাস্তার পাশে একটি খামারে কাঠের ঢেঁকিতে চাল ঢেলে অন্যপ্রান্তে ঢেঁকিতে পা দিয়ে চলছে চাল গুঁড়ো তৈরির কাজ।যে দৃশ্যই মনে করিয়ে দিচ্ছে ঢেঁকির মাহাত্ম্যের কথা।।