মনীষা মুখার্জী,কলকাতা,০২ ডিসেম্বর : কোনো প্রতিমার মধ্যে যখন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় তখনই তিনি হয়ে ওঠেন জীবন্ত বিগ্রহ। এই প্রাণ প্রতিষ্ঠা সেই সমস্ত মন্দিরেই হয়ে থাকে যেখানে ঠাকুর নিত্য পূজিত হন। বিগ্রহের সামনে দাঁড়ালে ভক্তরা নিজেরাই অনুভব করতে পারেন – ঠাকুর আছেন। আসলে ভক্তের ভক্তি, ঠাকুরের ঐশ্বর্যের প্রকাশ, লীলা মাহাত্ম্য ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপর এই অনুভব নির্ভর করে। বিগ্রহ হয়ে ওঠে জাগ্রত, জীবন্ত।
কলকাতার দ্য কলকাতা হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশের গলিতেই রয়েছে আছে এমন জীবন্ত এক কালীমা শ্যামসুন্দরীর মন্দির। দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে যান মায়ের দর্শনে। মায়ের ভুবন মোহিনী হাসিমাখা মুখের দিকে ভক্তরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, দৃষ্টি সরাতে মন চায়না। মায়ের পুজো হয় অন্ধকারে। পুজোর নিত্য প্রসাদ কী হবে তাও ঠিক করে দেন স্বয়ং মা। মায়ের কথা মেনে আজও পাকা কলা ও এক মুঠো আতপ চালে পূজিতা হন দেবী। মা এখানে পাঁচ বছরের ছোটো মেয়ে।
বহু বছর আগে এক মহালয়ার পূণ্য লগ্নে মা প্রথম দর্শন দিয়ে ছিলেন। মায়ের সেই অলৌকিক লীলা দেখেই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যান পুরোহিত। ভক্তদের প্রার্থনায় বিগলিত হয়ে তাদের ঘরে গিয়ে দর্শন দিয়ে আসেন। দূর দূর থেকে আসা ভক্তরাও মাকে দর্শন করলেই বুঝতে পারেন- মা এখানে সত্য সত্যই আছেন। পূণ্যার্থীরা মায়ের দর্শন করে বলেন,’মা যে আছেন, তা এখানে এসে উপলব্ধি করতে পারি।’ এই মন্দিরকে ঘিরে অনেক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন পুরোহিত এবং আগত ভক্তেরা। শোনা যায় আজও রাত্রের অন্ধকারে মা শ্যামসুন্দরী ধুলো পায়ে হেঁটে বেড়ান মন্দিরের প্রাঙ্গনে। মন্দিরের পুরোহিত বুঝতে পারেন কেউ যেন অনেক উঁচু থেকে ধপ করে নামলেন। কখনো বা তিনি মায়ের নূপুরের আওয়াজ শুনতে পান, যেটা সোজা ভৈরব দেবের ঘরে চলে যায়। কখনো পুরোহিত দেখেন- অনেক লম্বা লম্বা চুল, চারটে হাত, মুখটা অন্ধকারে ঢাকা। পরক্ষণেই দেখেন, সেখানে কেউ নেই।
আজ থেকে বহু বছর আগে মহালয়ার দিন শ্যামা সুন্দরী মায়ের এই মন্দিরে ঘটেছিলো এক অলৌকিক লীলা। কথিত আছে,ওইদিন মায়ের মন্দিরের পুরোহিত পুজোর বাজার করবার জন্য রাস্তায় গিয়ে দেখেন- পাঁচ বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে,পুরো গায়ে কালো রং মেখে, চোখে লাল রঙ দিয়ে মা কালী সেজে সকলের কাছে ভিক্ষা চাইছে। মন্দিরের পুরোহিতের কাছেও সেই মেয়েটি ভিক্ষা চায়। পুরোহিতের এই বিষয়টা ভালো লাগেনা। তিনি মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলেন, ‘কাজ করে খা’। বাচ্চা মেয়েটি তখনই উঠে দাঁড়িয়ে বলে,‘আমি যদি কাজই পেতাম তাহলে কি আর তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে আসতাম?’এরপর বাচ্চা মেয়েটি চলে যায়।
শোনা যায় যে পুরোহিত তার পছন্দমতো মায়ের ভোগের জন্য ফল, মিষ্টি, চাল, ডাল সবকিছু বেশি পরিমাণে কিনে মন্দিরে চলে যান। সেই দিন মায়ের অন্ন ভোগের ব্যবস্থা করা হয়। কালীপুজোর দীপান্বিতা অমাবস্যা ছাড়া প্রতিটা অমাবস্যায় মায়ের পুজো অন্ধকারে হয়। সেই নিয়ম মেনে অন্ধকারে মায়ের পুজো করা হচ্ছিলো। হঠাৎ পুরোহিত দেখলেন মহাদেব আছেন, কিন্তু মা নেই। পুরোহিত তখন ভাবলেন, মা তো কালো তাই অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়েছেন, তাই তাকে দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘিয়ের প্রদীপটা মায়ের সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। তখন তিনি দেখেন সেখানে সত্যি মা নেই। মহাদেব যেন শবের মতো পড়ে আছেন!
এই দৃশ্য দেখে পুরোহিত ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসেন। তার গা শিউরে ওঠে। তখন সেখানে ছমছম আওয়াজ হয়। মনে হয় কেউ যেন হেঁটে আসছে। এরপর মা ডান পা রাখেন মহাদেবের বুকের উপর। সেই অন্ধকারের মধ্যেই ফুটে ওঠে মায়ের মুখ। তখন মায়ের বিগ্রহের মধ্যে থেকে হাত বেরিয়ে আসে সেই ছোট্ট মেয়েটার। মা তখন পুরোহিতকে বলেন- চাল কলা খেতে দে আমায়। মায়ের সেই রূপ দেখে পুরোহিত অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। সেই মুহূর্তে তিনি শুনতে পান, মা যেন বলছেন,“ আমি শুধু বড়লোকের মা নই রে, আমি গরীবেরও মা। তাই আজ থেকে তুই যতই আমার জন্য বিশেষ পুজো করিস না কেন, যদি কোনো ভক্ত এক মুঠো আতপ চাল আর একটা পাকা কলা আমার কাছে নিবেদন করে, আমার কাছে তার থেকে বড় আর কিছু নেই।
তাই মায়ের কাছে চাল, কলা নিবেদন করলেই মা ভক্তদের সকল মনস্কামনা পূরণ করেন। তিনি কাউকেই খালি হাতে ফেরান না বলে বিশ্বাস ভক্তদের ।
মায়ের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এখানকার পুরোহিতরা বলেন- কারোর হয়তো সন্তান হয় নি, মায়ের কৃপায় তার সন্তান হয়েছে। কেউ চিরকাল ভাড়া বাড়িতে থেকেছে, তার হুঠ করে বাড়ি হয়ে গেলো। কেউ চাকরির আশা নিয়ে মায়ের কাছে এসে ছিলো, তার বড় জায়গায় চাকরি হয়ে গেলো এইভাবেই মা সব সময় ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। এই মন্দিরের পুরোহিত আরও বলেন- এখানে মাঙ্গলিক দোষ থেকে কাল সর্প দোষ সব কেটে যায় শুধুমাত্র মাকে দর্শনে। ৫১ সতীপীঠ দর্শনের ফলও লাভ হয় মায়ের দর্শন করলেই বলে তারা জানিয়েছেন ।
ভক্তি আর বিশ্বাসের সংমিশ্রণে আজও পূণ্যার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়ে আছে কলকাতার দেবী শ্যামসুন্দরী।।