জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,২৪ ডিসেম্বর : প্রকৃতি ছ’টা ঋতু তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যেও ঋতু অনুযায়ী ব্যস্ততা ও পোশাকের পরিবর্তন দেখা যায়। দক্ষিণের মলয় বাতাস তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে দোলা দিয়ে বসন্তের আগমন ঘোষণা করে। ভোরের শিশিরের আঘাতে শিউলির টুপটাপ ঝরে পড়া শব্দ এবং আকাশের সাদা মেঘের ভেলা শরতের ইঙ্গিত দেয়। উত্তুরের শীতল বাতাসের হাত ধরে আসে শীত ঋতু। মানুষের গায়ে ওঠে শীতের পোশাক। সঙ্গে আগমন ঘটে লেপ প্রস্তুতকারকদের।
ঠাণ্ডা পড়তে না পড়তেই দেখা যেত লেপ-তোষক৷ প্রস্তুতকারকরা কাঁধে ধুনচি ও সাইকেলের ক্যারিয়ারে তুলোর বস্তা নিয়ে চলেছে। তারপর কোনো একজায়গায় বসে গৃহস্থ বাড়ির পুরনো লেপ-তোষক ছিঁড়ে তুলে বের করে সেগুলি ধুনচি দিয়ে ধুনে নতুন করে পেঁজা তুলো তৈরি করে ফেলে। ধুনচির টুং টাং শব্দের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় মিষ্টি সুর। অবশেষে তৈরি হয় নতুন করে লেপ। লেপ তৈরি দেখতে ভিড়ও হতো ।
আজ সেসব কার্যত অতীত। লেপের পরিবর্তে এসে গেছে তুলনায় কম খরচের বালাপোষ ও নামীদামি কোম্পানির ব্ল্যাঙ্কেট। একটা লেপ সেলাই করতে যতটা খরচ তার কাছাকাছি দাম পড়ে ব্ল্যাঙ্কেটের। লেপের থেকে ওজনও কম । ফলে লেপের পরিবর্তে মানুষ বালাপোষ বা ব্ল্যাঙ্কেটের দিকে ঝুঁকছে বেশি । পাশাপাশি তুলোর তোষকের পরিবর্তে এখন বিভিন্ন বিভিন্ন কোম্পানি দামের স্পঞ্জের গদিতে ছেয়ে গেছে বাজার । খরিদ্দারদের মধ্যে স্পঞ্জের গদির কদরও রয়েছে যথেষ্ট । যেকারণে ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছেন লেপ-তোষক প্রস্তুতকারীরা ।
এখন ধুনচির পরিবর্তে যন্ত্রের সাহায্যে তুলো ধুনার কাজ চলছে। আগে একটা সময় এক একজন কারিগর আশ্বিন থেকে ফাল্গুন এই ৫-৬ মাসে মোটামুটি ৩০০-৪০০ পিস লেপ তৈরি করত। প্রতিটি লেপ তৈরি করে মোটামুটি ৩৫০-৪০০ টাকা পাওয়া যেত। এরমধ্যে অবশ্য তেল ও সুতো বাবদ ১০০ টাকার মত খরচ হতো। এখন ওই সময় গড়ে মাত্র ১০০ টার মত লেপ তৈরি হয়। স্বাভাবিক ভাবেই লেপ প্রস্তুতকারকদের পক্ষে সংসার নির্বাহ করা কার্যত কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেই বিকল্প কাজের সন্ধান করতে শুরু করেছে। কেউ কেউ কষ্ট হলেও পারিবারিক ব্যবসা ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
কথা হচ্ছিল মঙ্গলকোটের বিশিষ্ট লেপ প্রস্তুতকারক ভোলা সেখের সঙ্গে। প্রায় বছর চল্লিশ আগে বাবার হাত ধরে সে জয়পুরে আসে । বাবার কাছেই তার কাজ শেখা। বাবার সঙ্গে ঘুরে এলাকায় তার একটা আলাদা পরিচিতি গড়ে ওঠে। সবাই তাকে ভোলা বলেই ডাকে।
ভোলার বক্তব্য,’একটা সময় সারাবছর টুকটাক কাজ করলেও ঠান্ডা পড়লে ব্যস্ততা বেড়ে যেত। গ্রামের বাড়ি থেকে অতিরিক্ত কারিগর নিয়ে আসতে হত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কম মূল্যের বালাপোষ ও ব্ল্যাঙ্কেটের জন্য লেপের চাহিদা যথেষ্ট কমে গেছে। ফলে দিন দিন তাদের অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে। তবে তার আশা কম মূল্যের হলেও লেপের থেকে বালাপোষের স্থায়িত্ব কম। ফলে মানুষ আবার লেপ তৈরির দিকেই ঝুঁকবে।’।