প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৩ ডিসেম্বর : ফের বিপর্যয় বর্ধমান স্টেশনে ।এবার যাত্রী ভিড়ে ঠাসা স্টেশন প্ল্যাটফর্মের উপর ভেঙে পড়লো শতাব্দী প্রাচীন প্রকাণ্ড জলের ট্যাঙ্ক। বুধবার বেলায় বর্ধমান স্টেশনের ২ ও ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মের যাত্রী শেডের উপর জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়ায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে । জখম হয়েছেন ৩৪ জন।তাদের উদ্ধার করে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বর্ধমান স্টেশনের মূল প্রবেশদ্বারের উপরে থাকা ঝুল বারান্দা আচমকা ভেঙে পড়ায় এক জনের মৃত্যু হয়েছিল ।আহত হয়েছিলেন বেশ করেকজন ।একের পর এক ঘটে চলা এমন সব ঘটনায় স্বাভাবতই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মও কি এখন নিরাপদ নয় ? এর উত্তর যদিও আজও অধরাই রয়ে থাকে । তবে রেল দফতরের তরফে দাবি করা হয়েছে এদিনের দুর্ঘটনা নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটন করা হয়েছে।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গিছে ,এদিন বর্ধমান স্টেশনে হওয়া দুর্ঘটনায় মৃতরা হলেন,সোনারাম টুডু (২৯),মফিজা খাতুন (৩৫) এবং ক্রান্তি কুমার (১৭)। ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ে বাড়ি সোনারামের । বাকিদের মধ্যে মফিজা বর্ধমানের লাকুড্ডি এবং ক্রান্তি সাহেবগঞ্জের বাসিন্দা ।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বিকালে রেলের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকরা এবং পূর্ব রেলের সিপিআরও
কৌশিক মিত্র দুর্ঘটনাস্থলে পৌছান। সেখানে সবকিছু খতিয়ে দেখার পর পর তারা বর্ধমান হাসপাতালে যান । মৃত ও জখমদের সঙ্গে তারা কথা বলেন।পরে সন্ধ্যায় সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সিপিআরও কৌশিক মিত্র বলেন,’এখনও বর্ধমান হাসপাতালে ৩০ জন চিকিৎসাধীন আছেন ।জখমদের পরিবারের হাতে ইতিমধ্যেই ৫০ হাজার টাকার অনুদান অর্থ তুলে দেওয়া হয়েছে । রেল মন্ত্রী মৃতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ অর্থ দেবার ঘোষণা করেছেন ।’
যে জলের ট্যাঙ্কে ৫৩ হাজার ৮০০ গ্যালন জল মজুত করা হত তার রক্ষণাবেক্ষণ কি সঠিক ভাবে হত ? এর সেফটি অডিট কি হয়েছিল ? এর উত্তরে সিপিআরও বলেন,’হ্যাঁ মেইনটিনেন্স হয় । যা ঘটেছে সেটা একটা দুর্ঘটনা । ১৮৯০ সালে এই জলের ট্যাঙ্কটি তৈরি হয়েছিল । তবুও এই দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখার জন্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে ।’ তদন্তে কারুর গাফিলতি থাকার প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সিপিআরও জানিয়েছেন ।
বর্ধমান স্টেশন হল পূর্ব রেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন। দূরপাল্লার অনেক মেল ও এক্সপ্রেস ট্রেন যেমন এই স্টেশন হয়ে যাতাযাত করে তেমনই এই স্টেশন হয়ে চলাচল করে বহু লোকাল ট্রেন । সেই কারণে প্রতিদিনই যাত্রী ভিড়ে ঠাসা থাকে বর্ধমান স্টেশনের প্রতিটি প্ল্যাটফর্ম।সেই মত এদিন বেলায়
বর্ধমান স্টেশনের ২ এবং ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মও যাত্রী ভিড়ে ঠাসা ছিল।তাদের অনেকে আপ হাওড়া মোজাফফরপুর এক্সপ্রেস ট্রেন ধরার জন্য ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিলেন । আবার অনেক যাত্রী হাওড়া বর্ধমান লোকাল ট্রেন ধরার জন্য ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা অনুযায়ী বেলা তখন ১২ টা ১২ মিনিট হবে। হঠাৎতই একটা বিকট শব্দ হয় । তার পর মুহুর্তের মধ্যে বর্ধমান স্টেশনের ২ এবং ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মের উপর ভেঙে পড়ে প্রকাণ্ড জলের ট্যাঙ্ক । যাত্রী শেড সহ ভেঙে পড়া সেই জলের ট্যাঙ্কের অংশের নিচে চাপা পড়েন বহু যাত্রী । তারা আর্তনাদ শুরু করেন। তা দেখে বর্ধমান স্টেশনের অন্য প্ল্যাটফর্মে থাকা যাত্রীরা ২ এবং ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ছুটে এসে জখমদের উদ্ধার কাজে হাত লাগান । তারই মধ্যে জি আর পি,রেল পুলিশ,দমকল ও বিপর্যয় বাহিনী দুর্ঘটনাস্থলে পৌছায়। যাত্রীদের উদ্ধার কাজে হাত লাগায়। পরে পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজী এবং জেলার পুলিশ সুপার আমনদীপও ঘটনাস্থলে পৌছায়। ২ এবং ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে শুরু হয় উদ্ধার কাজ । একে একে ৩৭ জন জখম ব্যক্তিকে উদ্ধার করে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় । সোখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তিন জনকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। স্টেশন চত্তরে থাকা দোকানদারা জানান জলের ওই প্রকাণ্ড ট্যাঙ্কের রক্ষণাবেক্ষণ হত না। ট্যাঙ্ক থেকে বেশ কয়েকদিন ধরেই চুঁইয়ে জল পড়ছিল । তা সবার চোখে পড়লেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। ব্যবস্থা নেওয়া হলে হয়তো এদিন এতবড় ভয়ানক দুর্ঘটনা হত না।
এদিকে এই দুর্ঘটনা নিয়ে রেলের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন বিজেপি বিরোধী দল গুলি । । জেলার কংগ্রের নেতা গৌরব সমাদ্দার বলেন ,’শতাব্দী প্রাচীন বর্ধমান স্টেশনে রক্ষণাবেক্ষণ সঠিক ভাবে হয় না । ২০২০ সালের এই স্টেশনে মূল প্রবেশদ্বারের উপরে থাকা ঝুল বারান্দা ভেঙে পড়ায় এক জনের মৃত্যু হয়েছিল । আর এদিনের দুর্ঘটনায় তিন জন মারা গেলেন । রেলের যাত্রী সুরক্ষা এখন লাটে উঠেছে বলে গৌরব সমাদ্দার অভিযোগ করেন ’। একই ভাবে বর্ধমান স্টেশনের এদিনের ঘটনার জন্য রেল দফতরকে কাঠগড়ায় তুলেছেন বর্ধমান দক্ষিনের বিধায়ক খোকন দাস । বর্ধমান জিআরপি এদিনের ঘটনা নিয়ে আলাদা ভাবে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে।।