প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,৩০ নভেম্বর : এ যেন ঘোর আমাবস্যাতেও ’চাঁদ মামার’ দেখা পাওয়ার মত ব্যাপার ! একাউন্ট খোলার জন্যে গ্রামের কেউ কোন বেসরকারী ব্যাঙ্কে গিয়ে ’ফর্ম ফিলআপ করেননি, ব্যক্তিগত নথিপত্র জমা দেননি। অথচ দিন আনা দিন খওয়া পরিবারের বহু ব্যক্তির বাড়িতে পৌছে গিয়েছে একটি বেসরকারী ব্যাঙ্কের ’এটিম কার্ড’। আর তা নিয়েই এখন তোলপাড় পড়ে গিয়েছে পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষ ব্লকের কালনা গ্রামে। ওই বেসরকারী ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এনিয়ে মুখে ’কুলুপ’ আঁটলেও দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন ’’এটিম কার্ড’ পাওয়া ব্যক্তিরা । ঘটনার বিহিত চেয়ে গ্রামবাসীরা প্রসাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন।
খণ্ডঘোষ ব্লকের বেরুগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম কালনা । গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী । তাঁদের মধ্যে দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের বাসিন্দাই বেশী। এমন এক গ্রামের
বাসিন্দাদের বাড়িতে ’এটিম কার্ড’পৌঁছাতেই তাঁদের চোখ কপালে উঠে যায় । গ্রামবাসীদের কথা
অনুযায়ী ঘটনার সূত্রপাত হয় ৫-৬ মাস আগে ।
একজন ’ক্যুরিয়ার বয়’ হঠাৎতই এক ব্যাগ ’এটিএম কার্ড’ নিয়ে কালনা গ্রামে হাজির হয়। তা দেখে গ্রামের মানুষজন কার্যত স্তম্ভিত হয়ে যান। গ্রামের কয়েকজন ’এটিম কার্ড’ ভর্তি খামের উপরে চোখ বুলিয়ে দেখেন ,একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের বর্ধমান শহরের কার্জনগেটের পাশে সিটি টাওয়ারে অবস্থিত শাখা থেকে কার্ডটি গুলি পাঠানো হয়েছে। ক্যুরিয়ার বয়ের কাছে থাকা ‘এটিএম কার্ড’ ভর্তি খামের উপর গ্রাহকের নাম ঠিকানা উল্লেখ থাকলেও সঠিক কোন ’ফোন নম্বরের’ উল্লেখ ছিল না। ‘ক্যুরিয়র বয়’ খামের উপরে থাকা মোবাইল ফোনের নম্বর ধরে ফোন করে গেলেও কারুর সাড়া পায় না ।
গ্রামের বাসিন্দা রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী মঙ্গলবার জানান,’ক্যুরিয়র বয়’ গ্রামের লোকজনকে বলেন, যাঁদের ওই ব্যাঙ্কে একাউন্ট আছে তাঁদের অর্থাৎ সেই গ্রাহকদের নামে ’এটিএম কার্ড ’এসেছে। আরো অদ্ভুত ভাবে ক্যুরিয়র বয় জানান,প্রথম বারে এটিএম কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এবার দ্বিতীয় বার এটিএম কার্ড এসেছে। অথচ ওই দিনই গ্রামবাসীরা ক্যুরিয়র বয়কে পরিস্কার জানিয়ে দেয়, তাঁরা কোনদিনই ওই বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় কোন অ্যাকাউন্টই খোলেননি। বিষয়টি হালকা ভাবে না নিয়ে গ্রামবাসীরা এর রহস্য উদঘাটের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তাঁরা ধরে নেন কোন জালিয়াত চক্র এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।
গ্রামবাসী সেখ মতিউর রহমান বলেন,আমরা গ্রামের অনেকে জোটবদ্ধ হয়ে একদিন ওই বেসরকারী ব্যাঙ্কে যাই। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ প্রথমে আমাদের কোন পাত্তায় দেয়নি।পরে আরো বেশী লোকজন নিয়ে ফের আর এক দিন ব্যাঙ্কে গেলে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার তখন আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। ওইদিন তিনি জানান,আমাদের নামে নাকি ওই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে। ব্যাঙ্কের পাশবুকে আমাদের ছবি দেখানো হয় । মতিউর রহমানের কথায়,ছবিতেও অদ্ভূত ব্যাপার আমরা দেখতে পাই । কেউ মাঠে ১০০ দিনের কাজ করছে,কেউ বাড়িতে রান্না করছে,আবার কেউ গোয়ালে কাজ করছে সেই অবস্থার ছবি দিয়ে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সেইসব দেখিয়েই ম্যানেজার দাবি করেন,একাউন্ট আছে বলেই ’এটিএম কার্ড’ গেছে আমাদের বাড়িতে । এখানেই শেষ নয় । ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আমাদের আরও জানান,গত কয়েক বছরে নাকি গ্রামের এক একজনের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোটা টাকার লেনদেন হয়েছে। যদিও গ্রামের মানুষজন গোটা বিষয়টি নিয়ে আজও পুরো অন্ধকারে রয়ে গেছেন। তাঁরা লিখিত ভাবে গোটা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চেয়ে ব্লক ও জেলা প্রশাসনের দফতরে জানিয়েছে।
এই বিষয়ে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এদিন জানায়, অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তদন্ত চলছে। তবে জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজীকে এবিষয়ে এদিন জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে আমি কিছু বলবো না ।’ তবে জেলা পরিষদের সমাধিপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার বলেন,’অভিযোগ জমা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে ।’
এদিকে এই ঘটনা নিয়ে শাসক বিরোধী তর্জা এখন
তুঙ্গে উঠেছে খণ্ডঘোষে। বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র বলেন,খণ্ডঘোষ ও সংলগ্ন ব্লক গুলিতে ধান চাষ প্রধান চাষ। এসব ব্লক গুলিতে সংখ্যক রাইসমিল আছে । কালো টাকা সাদা করতে অসাধু রাইসমিল মালিকরা এলাকার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কালনা গ্রামে দরিদ্র মানুষজনের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে কেল্লাফতে করছে না তো ?’ এই প্রশ্ন সামনে এনে মৃত্যুঞ্জয়বাবু ইডির তদন্ত দাবি করেছেন ।
আর সিপিএম নেতা বিনোদ ঘোষ কোন রাখঢাক গুড়গুড় না রেখে স্পষ্ট জানিয়ে দেন,’তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা এই ঘটনায় অবশ্যই জড়িত । উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হলে এই সত্যটাই সামনে আসবে ।’ যদিও খণ্ডঘোষ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি তথা জেলা পরিষদের অধ্যক্ষ অপার্থিব ইসলাম জানান,’সব ব্যাপারে তৃণমূলের দিকে আঙুল তোলাটাই বিরোধীদের কাছে এখন অস্তিত্ব জাহিরের পথ হয়ে দাড়িয়েছে। তবে আমরাও চাই প্রশাসন যথাযথ তদন্ত করে ঘটনার আসল সত্য সামনে এনে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করুক ।’।