প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৩ নভেম্বর : কার্তিকের আমাবস্যার রাত্রি আলোক রোশনাইয়ে ভাসে গোটা বর্ধমান। তবে ওই দিনই নিভৃতে পূজিত হন বর্ধমানের তেজগঞ্জের বিদ্যাসুন্দর কালী । জন কোলাহল, আলোর রোশনাই,বিভিন্ন বাদ্যির শব্দ এ সব থেকে কার্যত যেন অন্তরালেই রয়ে থাকেন ভরতচন্দ্রের এই বিদ্যাসুন্দর কালী। তেজগঞ্জের নির্জন নির্ভৃত স্থানে পাষান মূর্তি দেবী বিদ্যাসুন্দর অবস্থান করলেও তাঁর প্রতি বর্ধমানবাসীর ভক্তিভাবে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে নি। নিত্যদিন পুজোপাঠ ও সন্ধ্যা আরতি হয় । নিজ মাহাত্মেই দেবী তাঁর ভক্তদের শ্রদ্ধার আসনে জায়গা করে নিয়ে আছেন।
বিদ্যাসুন্দর কালীর পুজো নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। রায়গুনাকার ভরতচন্দ্রের কব্যগ্রন্থেও উল্লেখিত রয়েছে বিদ্যাসুন্দর কালীর কথা ।কথিত আছে,একদা দামোদর তীরবর্তী তেজগঞ্জে ছিল জঙ্গল আবৃত।সেখানেই ছিল প্রাচীন কালী মন্দির।তদানিন্তন বর্ধমানের রাজারা ওই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন । এও শোনা যায় ওই সময়ে এই মন্দিরে দেবীর সামনে নরবলি হত। মন্দিরের আশেপাশে সুড়ঙ্গও নাকি ছিল। তবে সেই সুড়ঙ্গ কোথায়ছিল তা অবশ্য আজ আর কেউ বলতে পারেন না। তবে ওই সুড়ঙ্গের আজও জড়িয়ে রয়েছে এক প্রেম কাহিনী ।
কথিত আছে ,ওই সূড়ঙ্গ দিয়েই নাকি তদানিন্তন কালের রাজকন্যা বিদ্যার সাথে গোপনে দেখা করতেন সুন্দর। সুন্দর ছিলেন দক্ষিণ মশান কালীর গরিব পুজারীর সন্তান।রাজবাড়ি থেকে মন্দিরে পুজোর ফুল দিতে আসতেন মালিনীর মাসি। একদিন সুন্দর তার কাছে সুন্দর একটি মালা দেখতে পান । তিনি মালিনী মাসির কাছে জানতে পারেন মালাটি নাকি গেঁথেছে রাজকন্যা বিদ্যা। সুন্দর এর পরেই রাজকণ্যার সাথে দেখা করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলে বিদ্যা সেদিন ভয়ে পালিয়ে যায়।
কিন্তু পালিয়ে গেলে কি হবে।সুন্দরের মন উদগ্রীব হয়ে ওঠে বিদ্যার জন্যে।ধরা পড়লে একেবারে নিশ্চিৎ মৃত্যু জেনেও সুন্দর রাজবাড়ি অবধি সূড়ঙ্গ কেটে ফেলে। সুড়ঙ্গ পথ ধরেই সুন্দর রাজকন্যা বিদ্যার কাছে পৌছে যায় । সময় গড়ানোর সাথে সাথে গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বিদ্যা আর সুন্দরের মধ্যে । বিদ্যা আর সুন্দরের প্রণয় সম্পর্কে আবদ্ধ হবার কথা রাজার কানে পৌছে দেন তার চরেরা ।একথা জানার পরেই রাজা তেজগঞ্জের মন্দিরেই দেবী মায়ের সামণে নিজের মেয়ে আর তার প্রেমিককে বলির নির্দেশ দেন। হাঁড়িকাঠে তাদের দু’জনকে বলি করার ঠিক আগের মুহূর্তে দেবী মাকে প্রণামের অনুরোধ করে সুন্দর। তখনই মূর্ছিত হন কাপালিক।সোই মুহুর্তেই অন্তর্ধান করে বিদ্যা আর সুন্দর। তার পর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ মেলে নি। এরপর থেকে রাজার আদেশে মন্দিরে নরবলি বন্ধ হয়ে যায়।
ভরতচন্দ্রের সেই বিদ্যাসুন্দর কালী আজও রয়েছেন বর্ধমানের তেজগঞ্জে। এখানে এখনও রয়েছে সেই মূর্তি। আর রয়েছে ভৈরব আর পঞ্চানন্দ এই দুই মন্দির। কথিত আছে রাজনির্দেশে বাঁকুড়া থেকে এসে এই মন্দিরে পুজার ভার পেয়েছিলেন বর্তমান সেবায়েত বংশের পূর্ব পুরুষ ।একসময় এখানকার ভোগের প্রসাদ খেয়ে অনেকেই বেঁচে থাকতেন।সেই জাঁকজমক আজ আর নেই। তবুও শ্যামাপুজোর দিন এই মন্দিরে নিষ্ঠা সহকারে পুজো হয়। তার পর আবার নির্জনেই থেকে যান বিদ্যা সুন্দর কালী।।