এইদিন ওয়েবডেস্ক,১০ নভেম্বর : বছর খানেক আগে একটি টিভি চ্যানেলের বিতর্কে জনৈক মুসলিম ব্যক্তি হিন্দু দেবদেবী নিয়ে কটুক্তি করলে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মা ইসলামের নবী মুহাম্মদের বিবাহের প্রসঙ্গটি বিতর্কে উত্থাপন করেন । তানিয়ে ভারতের মুসলিমরা এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলি নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে কথিত ধর্মনিন্দার (Blasphemy) অভিযোগে সরব হয়েছিল । এমনকি নূপুর শর্মার ‘শিরোচ্ছেদ’ করার পর্যন্ত কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিল ভারতের জিহাদিদের । যদিও সেই ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা আজ স্তিমিত ।
তবে আজ থেকে ২৮৯ বছর আগে ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে একই ঘটনায় প্রাণ হারাতে হয়েছিল ১৪ বছরের হিন্দু সিন্ধি কিশোর হকিকত রাই বখমল পুরীকে (Haqiqat Rai Bakhmal Puri) । মিথ্যা ধর্মনিন্দার অভিযোগে ছোট্ট ছেলেটিকে নির্মমভাবে পাথর ছোড়ার পর শিরোচ্ছেদ করেছিল তৎকালীন মুসলিম হানাদারদের দল ।
আক্রার (Akkra)গীতিনাট্য অনুসারে,হকিকত বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটের এক হিন্দু খত্রী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ধনী পরিবার । তার পিতা ছিলেন বাঘমাল । মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গেলার( ১৭১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭৪৮ এপ্রিল) শাসনকাল তখন । প্রদেশের শাসনভার ছিল জাকারিয়া খানের হাতে । মুসলিম শাসকরা সেই সময় সমস্ত গুরুকুল তুলে দিয়েছিল । ব্যাপকভাবে চালু ছিল কেবল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা । সেই সময় মূলত ফার্সি ভাষার প্রচলন ছিল। মুঘল আমলে আদালত থেকে সমস্ত প্রশানিক কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হতো শুধুমাত্র ফারসি ভাষায় । সেই কারনে হকিকত রায়কেও একজন মৌলবীর কাছে ফারসি পড়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল।
কিন্তু মুসলিম সহপাঠীদের মাঝে পড়াশোনা করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল হকিকত । কারন হিন্দু ধর্ম, গুরু নানক ও হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে মুসলিম সহপাঠীর নিরন্তর কুমন্তব্য ও গালাগালি সহ্য করে যেত হত তাকে । গুরু ঝুলেলালের কাছে আজন্ম ভগবদ্গীতা শিখে বড় হয়ে ওঠা হকিকত রাইয়ের অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে একদিন ।
তবে নিজের মেজাজ হারায়নি ১৪ বছরের হিন্দু কিশোর হকিকত । ধীর কন্ঠে সে মুসলিম সহপাঠীদের উদ্দেশ্যে বলে,’তোমরা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ । এতদিন আমি নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, কিন্তু তোমরা ভুলে আচ্ছ আমারও জিহ্বা আছে । আমিও তোমাদের ধর্ম, গুরু এবং ঈশ্বরের সম্পর্কে বলতে পারি ।’
এর উত্তরে হকিকতের মুসলিম সহপাঠীরা তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলে, ‘বলে দেখো,তারপর তোমার কি অবস্থা করি দেখতে পাবে ।’ মুসলিম সহপাঠীদের একতরফা হিন্দু ধর্মের অবমাননা সহ্য করতে পারেনি কিশোর হকিকত রাই ।
‘সুরুচি প্রকাশন’ কর্তৃক সংকলিত হকিকত রায়ের জীবনী থেকে জানা যায়, ঈদের দিন হকিকত রায় মৌলবী সাহেবকে একটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে উৎসবের শুভেচ্ছা জানান। এদিকে অন্যান্য ছাত্ররা তাকে কাবাডি খেলার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল, কিন্তু মা ভবানীর শপথ করার পর হাকিকত রাই বললেন যে তার খেলতে ভালো লাগছে না। এরপর যা ঘটল, মুসলিম ছাত্ররা মা ভবানীকে ‘পাথরের টুকরো’ বলে অভিহিত করে এবং তার মূর্তি রাস্তায় ফেলে দেওয়ার এবং তাকে লাথি মারার হুমকি দেয়।
‘গেটওয়ে টু শিখিজম’ এবং সুরুচি প্রকাশনে প্রকাশিত হকিকত রাইয়ের জীবনী অনুসারে, তিনি কেবল মা ভবানীকে অপমান করা মুসলিম ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যদি কেউ তাদের শ্রদ্ধেয় ফাতিমা বিবিকে একই কথা বলে তবে তাদের কেমন লাগবে? ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে ইসলামের সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর মেয়ের সম্পর্কে একজন হিন্দু কিশোরের মুখে শোনার পর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মুসলিম উগ্রবাদী পড়ুয়াদের দল । তারা কালবিলম্ব না করে প্রথমে স্থানীয় মৌলবী জানায় । ক্রমে সেই কথা চাওড় হতেই মোল্লা- মৌলবীরা চিল চিৎকার শুরু করে দেয় । দাবি তোলে হিন্দু কিশোর হকিকতের শিরোচ্ছেদ করতে হবে । তদনুসারে কাজীর কাছে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল ।
হকিকতকে টানতে টানতে কাজীর সামনে নিয়ে যাওয়া হয় ।
এদিকে ছেলের সম্ভাব্য পরিনতির কথা শুনে উদভ্রান্তের মত কাজীর কাছে ছুটে যান হকিকতের বাবা-মা । তাঁরা কাজির পায়ে ধরেন । নিজেরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিনিময়ে ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাতর আকুতি জানান কাজীর কাছে । কিন্তু কাজি ফরমান দেয় যে হকিকতকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে তবেই তার প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হবে । কিন্তু হকিকত সাফ জানিয়ে দেয় যে সে কোনো অসত্য বলেনি,তাই কোনো অবস্থাতেই স্বধর্ম ত্যাগ করতে পারবে না । বাবা বাঘমালও ছেলের প্রাণ বাঁচাতে তাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন ।
তখন ছোট্ট হকিকত বাবাকে উত্তর দেয়, ‘বাবা তুমিই না বলেছ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,’শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুনঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্টিতাৎ। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্মো ভয়াবহঃ'( স্বধর্মের অনুষ্টান দোষযুক্ত হইলেও উত্তমরুপে অনুষ্টিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মুত্যুও হয় তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্টান করা বিপজ্জনক)।
নির্ভীক কিশোর সন্তানের মুখে একথা শোনার পর মাথা হেঁট করে সেখানেই বসে পড়েন বাঘমাল । তার চোখ দিয়ে ঝড়ে পড়ে অশ্রু ধারা । অবশেষে কিশোর হকিকত রাইয়ের শিরোচ্ছেদের ফরমান জারি করে দেয় কাজী ।
এই ফরমানের পর কিশোর হকিকতকে নিয়ে যাওয়া হয় বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে । জাকারিয়া খানের উপস্থিতিতে হকিকতকে বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হয় । জাকারিয়া নির্দেশ দিলে হকিকতকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি পাথর ছুড়তে থাকে উপস্থিত মুসলিম মৌলবাদীদের দল । শেষে নিদারুন যন্ত্রনায় হকিকত ঝিমিয়ে পড়লে জল্লাদ তাকে শিরোচ্ছদ করে হত্যা করে ।
হকিকত রাই মাত্র ১৪ বছর বয়সে ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন । দেহ ত্যাগ করলেও ধর্ম ত্যাগ করেননি তিনি । হকিকত রাই ধর্মের জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন কিন্তু তার আত্মত্যাগ সিন্ধি সম্প্রদায়ের হাজার হাজার সৈন্যকে উৎসাহিত করেছিল । আজও পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরে কিশোর হকিকত রাইয়ের সমাধিতে মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার সাথে পূজো করেন স্থানীয় শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ । এমনকি শিখ সম্রাট রঞ্জিত সিংও হকিকত রায়ের আত্মত্যাগে গর্বিত ছিলেন। ‘শের-ই-পাঞ্জাব’ রঞ্জিত সিং, যিনি ১৮ শতকে ইসলামি শাসক ও ব্রিটিশদের পরাজিত করেছিলেন, প্রায়শই তাঁর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করতেন ।।