শ্যামসুন্দর ঘোষ,মেমারি(পূর্ব বর্ধমান),১৪ অক্টোবর : প্রত্যন্ত জনপদ । হাতে গোনা কয়েকটা পরিবারের বসবাস গ্রামে ৷ পরিবারগুলির মূল পেশা মূলত কৃষিকাজ অথবা খেতমজুরি । সকলেই আর্থিকভাবে দূর্বল । এই অবস্থায় শারদোৎসব উদযাপন বিলাসিতার নামান্তর । কিন্তু যখন গাছ ভর্তি শিউলি ফুল আর মাঠে কাশফুল দোলা দিত হিমেল হাওয়ায়,মনটা যেন কেমন উদাসী হয়ে যেত গ্রামবাসীদের । গ্রামবাসীদের এই যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছিলেন পূর্ব বর্ধমান মেমারি-২ ব্লকের বিজুর-২ অঞ্চলের বেগুনিয়া গ্রামের ভট্টাচার্য পাড়ার বাসিন্দারা । আজ থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগে ৭১৪ বঙ্গাব্দে দূর্গাপূজোর সূচনা করেন ভট্টাচার্যের পরিবারের লোকজন । কিন্তু প্রত্যেকেরই তথৈবচ অবস্থা । অগত্যা ১২ জন শরিক মিলে শুরু হয় পূজো ৷ এদিকে গ্রামে শারদোৎসব পালন হবে শুনে সেকি আনন্দ সকলের । প্রত্যেকেই সামর্থ্য মত চাল,ডাল, শব্জি, তেল,নুন জমা দিতে শুরু করে পূজো উদ্যোক্তাদের হাতে । তা দিয়ে নবমীর দিন হয় গনভোজ ৷ তখন থেকেই ভট্টাচার্য পরিবারের দেবী দূর্গার নাম হয় ‘১২ ঘরের মা’৷
সময়ের সাথে সাথে গ্রামবাসীদের আর্থিক অবস্থা বদলায় ৷ ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যরা একে একে কর্মসূত্রে বিহারে, কাটোয়া,কলকাতা, কাঁচরাপাড়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন ৷ কিন্তু বেগুনিয়া গ্রামের ‘১২ ঘরের মা’-এর মায়ের পূজো আজও চলে আসছে ৷ পারিবারিক থেকে ক্রমে সার্বজনীন রূপ পায় এই পূজো । আজও পূজোর খরচার জন্য গ্রাম নির্বিশেষে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ৷ সকলের সমবেত দানেই পরিচালিত হয় দেবীর আরাধনা । দানের অর্থেই নির্মিত হয় দেবীর পাকা মন্দির ।
আজ শনিবার মহালয়ার দিনে মন্দিরে আনা ঘটে বিশেষ পূজোর আয়োজন করা হয়েছিল । মন্দির প্রাঙ্গনে বসে ভট্টাচার্য পরিবারের অন্যতম সদস্য তাপস কুমার ভট্টাচার্য,তপন কুমার ভট্টাচার্যরা ‘১২ ঘরের মা’-এর মায়ের পূজোর সূচনার কথা বলতে গিয়ে কিছুটা আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েন । তাঁরা বলেন,’আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেক অভাবের মধ্যে ‘১২ ঘরের মা’-এর মায়ের পূজোর সূচনা করেছিলেন । জাতপাত নির্বিশেষে গ্রামের প্রতিটি মানুষ পূজোয় অংশগ্রহণ করেন । ‘১২ ঘরের মা’কে ঘিরে সকলের একই আবেগ কাজ করায় সামর্থ্য থাকলেও আজও গ্রামে দ্বিতীয় দূর্গাপূজো করা হয়না।’
তাঁরা আরও বলেন,’আজও স্থানীয় কুন্ডু পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে একচালের দেবীর প্রতিমা তৈরি করে আসছেন । পুরোহিতের দায়িত্ব ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যরাই পালন করে আসছেন । নবমী অথবা দশমীর দিন অন্নভোগ হয় । গোটা গ্রামের মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করেন । দেবীর নামে অল্পসল্প কিছু জমিজমা আছে,তা থেকে বছরভর উপার্জন আর গ্রামবাসীদের দানের অর্থেই আমাদের গ্রামের ‘১২ ঘরের মা’-এর পূজোর খরচখরচা চলে ।’
গ্রামবাসীরা জানান,আজও প্রাচীন প্রথা মেনেই বেগুনিয়া গ্রামের ‘১২ ঘরের মা’-এর পূজো হয় । রথের দিন দেবীর কাঠামোয় মাটি দেওয়া হয় এবং সেদিন পূজা হয় । বোধন পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় দেবীর পূজো হয় । দশমীর দিন বিসর্জন হয় ।
বেগুনিয়া গ্রামের ‘১২ ঘরের মা’কে অত্যন্ত জাগ্রত বলে মনে করেন গ্রামবাসীরা । পূজোতে বলিদান প্রথা রয়েছে । অষ্টমী ও নবমীর দিন ছাগ বলি । অনেকে মানত করেন,তাঁরাও ছাগবলি দিতে আসেন । এছাড়া পূজোর দিনগুলিতে বিভিন্ন সমাজ সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । এবারে এবারে চক্ষু পরীক্ষা শিবির ও দরিদ্রদের মধ্যে নতুন বস্ত্র বিতরণ হবে বলে জানিয়েছেন পূজো উদ্যোক্তারা ।।