প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১২ সেপ্টেম্বর :
মনীষীদের ছবি ও বাণী লেখা রংচঙে স্কুল ঘর আছে। পড়ুয়া আছে,শিক্ষকও আছেন। নেই শুধু
স্কুলের অধিকাংশ শ্রেণী কক্ষের মাথার উপর ছাদ। তাই মাথার উপর ছাদ থাকা অবশিষ্ট একটি মাত্র শ্রেণী কক্ষে গাদাগাদি করে বসেই শিক্ষকের কাছে পাঠ নিতে হয় পড়ুয়াদের। আর আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলেই ছুটি হয়ে যায় স্কুল।এটা কোন গল্প কথা নয়। বাস্তবেই দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই ভাবেই চলছে পূর্ব বর্ধমানের রায়না-১ ব্লকের হাকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়।স্কুলের এই দুর্দশা কবে কাটবে তা কারুরই জানা নেই।প্রশাসন ও স্কুল শিক্ষা দফতর কবে নড়েচড়ে বসে সেদিকেই তাকিয়ে আছেন শিক্ষক, অভিভাবক, পড়ুয়া ও গ্রামবাসীরা।
রায়না-১ ব্লকের হাকৃষ্ণপুর গ্রামের ছেলে মেয়েদের
শিক্ষার আলোকে আনার লক্ষে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা পায় হাকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়।শুরুর পর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল বিদ্যালয়টি। কিন্তু ২০২০ সালের মে মাসে হওয়া আম্ফান ঝড়ের তাণ্ডবে সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায় । ঝড়ের দাপটে উড়ে যায় বিদ্যালয়ের একাধীক শ্রেণীক্ষের উপরে থাকা টিনের চালা।তার পর থেকে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর কেটে গিয়েছে।কিন্তু শ্রেণীকক্ষ গুলির মাথার উপরের চালা আর পুননির্মাণ হয় নি।।তাই বৃষ্টি নামলেই জলে ভাসে বিদ্যালয়।তবে জল ঝড়ের মধ্যেও অক্ষত রয়ে আছে বিদ্যালয়ের দেওয়ালে আঁকা থাকা মনীষীদের ছবি।তার পাশে আজও জ্বলজ্বল করছে পড়ুয়াদের উদ্দেশ্যে লেখা “বই পড়ব,পড়ে শিখব,আরো জানব“, এই মূল্যবান কথা গুলি।কিন্তু তাতে আর কি যায় আসে আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলেই ছুটি হয়ে যাওয়া স্কুলের পড়ুয়াদের !
বিদ্যালয়ের টিচার ইনচার্য সঞ্জীব কুমার সোম এই প্রসঙ্গে বলেন,“আম্ফান ঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্যালয়ের তিনটি শ্রেণী কক্ষের টিঢের চালা উড়ে যায়। ওই চালা পুননির্মানের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি রাজ্য ও জেলা প্রশাসন ,শিক্ষা দফতর সহ নানা মহলে আবেদন নিবেদন করেছেন।কিন্তু সুরাহা আজও মেলে নি।তাই মাথার উপর ছাদ থাকা বিদ্যালয়ের সর্বশিক্ষা মিশনের একটি মাত্র ঘরে প্রি-প্রাইমারি থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ৪২ জন পড়ুয়াকে গাদা গাদি করে বসাতে হয়।ওই ঘরেই তিনি এবং অপর শিক্ষিকা মল্লিকা কোনার মিলে পাঠ দান করেন“। সম্প্রতি পঞ্চায়েত সমিতি একটি ঘরের জন্য অর্থ বরাদ করেছে।সেই ঘরের নির্মান কাজ এখন চলছে
বলে সঞ্জীব সোম জানিয়েছেন।
সে না হয় হল , তা বলে আকাশে মেঘ দেখা দিলেই স্কুল ছুটি দিয়ে দিতে হয় কেন ? এর উত্তরে টিচার ইনচার্য বলেন,“অভিভাবকরা আমাকে বলে দিয়েছেন আমাদের স্কুলে মিডডে মিল রান্নার ঘরটি
ভালো থাকলেও একাধীক শ্রেণী কক্ষের মাথার উপর ছাদ নেই , চালাও নেই।বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হলে পড়ুয়াদের বিপদে পড়তে হতে পারে ।এমন আশঙ্কা করে অভিভাবকরা বলে দিয়েছেন,আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখলেই পড়ুয়াদের ছুটি দিয়ে দিতে হবে।সেই কারণে বৈশাখ থেকে ভাদ্র,এই পাঁচ মাস আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলেই পড়ুয়াদের ছুটি দিয়ে দিতে হয় বলে টিচার ইনচার্য সঞ্জীব সোম জানিয়েছেন“। পাশাপাশি তিনি এও বলেন,“,স্কুলের দুরাবস্থার জন্য অভিভাবকরা আমাদের স্কুল থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পাশের স্কুলে তাঁদের ছেলে মেয়েদের ভর্তি করাচ্ছেন। তাই আমাদের স্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা দিন দিন কমছে’।স্কুলটির হাল ফেরাতে শিক্ষা দফতরের সহযোগীতা প্রার্থনা করেছেন টিচার ইনচার্য।
এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন,একসময়ে আমরা হাকুষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি।এখন সেই বিদ্যালয়ের দুরাবস্থা
দেখে আমাদের দুঃখ হয়।বিদ্যালয়ের একাধীক শ্রেণী কক্ষের মাথার উপর ছাদ নেই,চালাও নেই ।
বিদ্যালয়ে যে কজন পড়ুয়া রয়েছে তাদেরও কষ্টের শেষ নেই।স্কুলে মাত্র দু’জন শিক্ষক । শ্রেণী কক্ষের অভাবে চার চারটে ক্লাসের ছেলে মেয়েদের একটা ঘরে গাদাগাদি করে বসিয়ে পাঠ দিতে বাধ্য হচ্ছেন
শিক্ষকরা। স্কুলের চার পাশে পাঁচিল পর্যন্ত নেই।
পরিকাঠামো গত এইসব ঘাটতির কারণে এলাকার অভিভাবকরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের আর এই স্কুলে ভর্তি করাতে চাইছেন না।স্কুলটির হাল ফেরাতে প্রশাসন ও শিক্ষা দফতরের উদ্দেশ্যে আর্জি রেখেছেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসীর মতই রায়না-২ চক্রের স্কুল পরিদর্শক (এস আই) শ্রাবন্তি ঘোষও হাকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুরাবস্থার কথা স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন,“আম্পান ঝড়ে বিদ্যালয়ের ক্ষয় ক্ষতি হওয়ার পর ছবি সহ সব তথ্য আমি জেলা শিক্ষা দফতর সহ জেলা প্রশাসনের সব মহলে পঠিয়েছি।এমনকি স্কুলের বর্তমান সমস্যা ও দুরাবস্থার বিষয়েও সবিস্তার রিপোর্ট আমি সব মহলে জমা দিয়ে রেখেছি। এখন কি ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেই বিষয়টি নিয়ে আমিও অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মতই প্রতীক্ষায় আছি বলে শ্রাবন্তি ঘোষ জানিয়েছেন ।
এই ঘটনা নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিজেপি নেতৃত্ব। জেলা বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র বলেন, ‘এই রাজ্যের তৃণমূল সরকার খেলা, মেলার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে।ক্লাবের দুর্গা পুজোর জন্য মোটা টাকা অনুদান দেয়,বিধায়কদের মাইনে একধাপে বহুগুন বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিন বছর ধরে আবেদন নিবেদন করে চললেও সরকারের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পাচ্ছে না।’ তৃণমূল সরকারের কাছে এটাই প্রত্যাশিত বলে মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র মন্তব্য করেছেন।
যদিও জেলা পরিষদের সভাধিপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার সব শুনে বলেন,’কিছুদিন হল আমি দায়িত্ব পেয়েছি। স্কুলটির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। স্কুলের টিচার ইনচার্য যদি আমাকে লিখিত ভাবে সবিস্তার জানান ,আমি অবশ্যই স্কুলটির উন্নতি সাধনে পদক্ষেপ নেব ।’।