কুন্তী – আজ আমার এই শূন্যতার আঙিনায় কে তুমি দাঁড়িয়ে?
আবছায়া অন্ধকার, চারিদিক শব্দহীন! এ তো আমার
একলার স্থান! প্রত্যহ এ নির্জন স্থানে আমি নিজেই
নিজের সঙ্গে বাক্যালাপ করি। তবে কি তুমি আমারই
সত্তা?
গান্ধারী – না। আমি গান্ধারী।
কুন্তী – গান্ধারী? কৌরব রাজমাতা! এখানে আজ আচম্বিতে!
গান্ধারী – দীর্ঘদিন অন্ধ কূপে পতিতা ছিলাম, পতি প্রেম, সন্তান স্নেহ আমার দু চোখে এঁটে বসে ছিল মৃত্যুর পরেও,
আজ মনে হলো একবার নিজের সঙ্গে কথা বলা দরকার
তাই এলাম এই আঙিনায়। কেমন আছো কুন্তী, বোন?
কুন্তী – কেমন আছি? বেশ আছি দিদি। ভালো আছি। আমি রোজ এইখানে আসি, অতীত কুড়োই, অভিমান আর রাগ সাজিয়ে সাজিয়ে অট্টালিকা বানাই। আর সেই অট্টালিকার
ছাদে উঠে চিৎকার করি, ঋষি দুর্বাসা! আপনি কি জানতেন, আমার জীবনে শুধুই সন্তান উৎপাদন থাকবে? কোনো যৌনতা নয়? তাই কি অমন বর দিয়েছিলেন আমায়?
গান্ধারী – কুন্তী!
কুন্তী – হ্যাঁ দিদি! আমি এই আঙিনার অন্ধকারের ভিতর থেকেও সূর্যকে ডাকি, জিজ্ঞেস করি, হে ভানু! তুমি আমার মন্ত্রের বলে আমাকে সন্তান দিয়েছো ঠিক, এবং পরে আমার কৌমার্য ফিরিয়ে দিয়েছো, আমার কিশোরী মনের খেয়াল বুঝতে পেরে, তবে প্রথমে কেন আমায় বুঝিয়ে দাও নি, এভাবে পুতুল খেলার মত সন্তান খেলা করা ঠিক নয়?
কেন তাকে জন্ম দিলে?
গান্ধারী – কিন্তু কুন্তী, সেই কর্ণের কাছেই তো তুমি ছুটে গিয়েছিলে বোন! তোমার আত্মজ তোমার গর্ভের ঋণ অস্বীকার তো করেনি!
কুন্তী – হুঁ! দিদি! তুমিও আমার যুদ্ধের রাজনীতিটুকুই দেখলে সবার মত, কিন্তু ওকে কাছে না রাখতে পারার যন্ত্রণা বুঝলে না!
গান্ধারী – রাজনীতির কথা বলছো? সে তো তোমার ছিলই বোন, আর তাছাড়াও যা ছিল তা অবিচার! একজন নারী হয়ে কেন দ্রৌপদীর উপর ওই রকম এক অন্যায় হুকুম জারি করেছিলে? কেন একজন নারীকে পাঁচ সন্তান দ্বারা ভাগ করে নিতে বলেছিলে?
কুন্তী – দিদি! তোমার দেবর পাণ্ডু, তার যে এমন অভিশাপ, আমি তা কেমন করে জানতাম বলো তো! মন্ত্রবলে সন্তান লাভ করে সে তার বংশ রক্ষা করতে চেয়েছিল। আমি ছিলাম তার সন্তান নির্মাণের উপাদান মাত্র! যদি অর্জুনের এই অসুখ হতো! যদি দ্রৌপদীকেও আমার মত সারাজীবন শরীরের আগুন নিয়ে সুখের সাধনা করতে হতো, তাই ভাবলাম পাঁচ জনের কেউ তো ওকে সুখী করতে পারবে!
গান্ধারী – আমাকে দেখো, সারাজীবন অন্ধ সেজে স্বামীর সেবা করে সন্তানদের মঙ্গল কামনা করে জীবন কাটিয়ে দিলাম। পুত্র দুর্যোধনকে বাঁচাতে শেষে যখন চোখ খুললাম, তখনও সে আমাকে ঠকালো, কেন ঠকালো! তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র কৃষ্ণ তাকে পরামর্শ দিল, সাবালক পুত্র মায়ের সামনে নগ্নতা শোভা পায় না! আমার দৃষ্টি দিয়ে আমি তার ওইটুকু স্থান বাঁচাতে পারলাম না। তোমার পুত্র ভীম কপটতার আশ্রয় নিয়ে তার নিম্নাঙ্গে আঘাত করে তাকে মেরে ফেললো! কী শিক্ষা তোমার! কী তোমার রাজনীতি! আহা!
কুন্তী – দিদি! এ আমার শিক্ষা নয়! এ যুদ্ধের কৌশল!
কিন্তু দিদি ওই দেখো, দূরে ওই আর এক আবছায়া কে ওখানে?
গান্ধারী – হ্যাঁ সেই তো! কে তুমি? এদিকে এসো!
মাদ্রি – আমি, আমি মাদ্রি!
কুন্তী – মাদ্রি! তুই? আমার পতি ঘাতক!
মাদ্রি – না! আমি পতি ঘাতক নই! সেদিন উনিই ভীষণ জোর করেছিলেন আমায়! দিদি এতক্ষণ তুমি যা যা বলছিলে তোমার যন্ত্রণার কথা, তা তো আমারও। কেন উনি আবার আমাকে বিবাহ করেছিলেন বলো? তোমরা কেন কেউ তাতে বাধা দাওনি দিদি? আমিও তো যৌন জ্বালায় জ্বলেছি দিন রাত! তোমার শেখানো মন্ত্রে জন্ম দিয়েছি নকুল সহদেবকে।
কুন্তী – মাদ্রি! কিন্তু তোর সন্তানদের আমি কখনো আলাদা করে দেখিনি, এটা তো বলবি!
মাদ্রি – হ্যাঁ, সেই জন্যই তো স্বামীর সঙ্গে নিশ্চিন্তে সহমরণে আসতে পেরেছি।
গান্ধারী – সহমরণে তুমি কি স্বামী সেবা করতে গেছো নাকি মাদ্রি? তুমি গেছো, লোভে, সমস্ত অলংকার, সুখ এমনকি প্রিয় দাসীকে শুদ্ধ নিয়ে গেছ, স্বর্গরাজ্যে সুখে সংসার করতে! এখন কী হলো, তুমিও যে এই আঙিনায় এসেছো বড় আজ!
মাদ্রি – হুঁ! আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আমার সেই বোকামো! সেই আবেগ! এখানে এসেও আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি একা বুকফাটা যন্ত্রণা নিয়ে! আমার জন্মও হলো না, মৃত্যুও হলো না!
গান্ধারী – মৃত্যুর পরেও বলছো মৃত্যু হল না!
মাদ্রি – না না হলো না! মনের মৃত্যু হল কই?
সেই ইচ্ছের মৃত্যু হল কই?
এত আত্মার ভিড়ে আমিও তো আর পাণ্ডু রাজার আত্মা খুঁজে পাইনা, যাকে জিজ্ঞেস করবো, বলো আমায় কেন বিয়ে করেছিলে?
গান্ধারী – কুন্তী, ওই ওই তোমার পিছনে ওটা কে এসেছে?
কুন্তী – কই দিদি? হ্যাঁ হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি, দ্রৌপদী তুমি!
দ্রৌপদী – হ্যাঁ মা! আমি…ঘুম ভাঙলো অনেক দিনের পরে, দেখলাম আপনারা সব জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন এইখানে, তাই চলে এলাম।
আমার কিছু কথা বলবো কি মা, জ্যেঠিমা?
কুন্তী – হ্যাঁ বলো বলো, আজ আমরা এই শূন্যতার আঙিনা ভরিয়ে তুলবো আওয়াজে, সবাই মিলে!
দ্রৌপদী – শুধু একটা কথা মা! আপনার ছেলেদের আরোও অন্য বউ ছিল, তারা বহুগামী ছিল। কিন্তু মা, পঞ্চস্বামিত্বের স্বীকৃতি আপনার আদেশেই, আমার ব্যক্তিমতের স্থান ছিলোনা। তবুও আমাকেই অগ্নিপরীক্ষায় সতীত্বের প্রমাণ দিতে হয়েছে আমৃত্যু। কিন্তু কেন, এর বাইরেও কি কোনো সন্দেহের কারণ ছিলো?! কই বহুগামী হওয়া সত্ত্বেও আপনার পুত্রদের তো কোনো দিনই পবিত্রতার পরীক্ষা দিতে হয়নি আমাকে ভোগ করার আগে?! নারদকে একটু জিজ্ঞেস করবেন মা, কেন আমাকেই প্রত্যেক বার আগুনপথে হাঁটতে হতো! জানেন তো, এখনো মনে হয়, ওঁদের গায়ে একবার অন্তত যদি সে অগ্নিজ্বালা দিতে পারতাম!
কুন্তী – থাক মা! ওরা তোমার স্বামী!
দ্রৌপদী – স্বামী! হাসালেন! পাণ্ডুরাজ আপনার স্বামী নন বুঝি!
গান্ধারী – চুপ! চুপ! কেউ একজন কাঁদছে! কে, কে ও?
ঊর্মিলা – আমি, আমি ঊর্মিলা!
গান্ধারী – কি করছো তুমি ওখানে?
ঊর্মিলা – অভিমান খুঁড়ে খুঁড়ে কবর রচনা করছি।
কুন্তী – কেন?
ঊর্মিলা – বনবাস থেকে ফিরে এলে ভ্রাতৃভক্ত লক্ষ্মণকে বলবো, যাও! ধরণী দ্বিধাখণ্ডিত, এবার প্রবেশ করো!
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পর কারাগারও বন্ধু হয়ে যায়! আমারও হয়েছে। চোদ্দ বছর অপেক্ষার পর আর সন্তান চাই না, আমার! ব্রহ্মচর্য আর উপবাসই শ্রেয়!
কুন্তী – ঊর্মিলা…!
সমবেত স্বর – আমরাও এসেছি আজ! চিত্রাঙ্গদা…মন্দোদরী…উলুপি…সীতা…
বসুন্ধরা – আমিও এসেছি!
গান্ধারী – তুমি কে? এত জ্যোতি তোমার অঙ্গে! কে তুমি মাতা?
বসুন্ধরা – আমি বসুন্ধরা! এসো, আমরা সবাই মিলে এই অভিমানের আঙিনায় এক আকাশ রোদ্দুর হয়ে ঝলমল করে উঠি!
কুন্তী – মাতা!
বসুন্ধরা – চলো, তোমাদের রামধনু করে দিই!
গান্ধারী – কিন্তু আমাদের অভিমানের প্রাসাদ, কিংবা কবর …ওদের কী হবে?
বসুন্ধরা – ওরা মেঘ হবে, তোমরা মেঘের বুকের উপরে রঙিন হয়ে প্রস্ফুটিত হবে দিক দিগন্তে…!