তরুণ কবি অরুণাভ ভালবেসেছিল মঞ্জুষা নামে পাড়ার এক কলেজ-পড়ুয়া মেয়েকে।
মঞ্জুষা ওকে কথা দিয়েছিলো,’আমার কথার রকমফের হয় না। কেউ আমাকে তোমার ভালোবাসা থেকে সরাতে পারবে না । আমার সঙ্গে চলতে থাকো।’
শুনে খুব খুশি অরুণাভ মঞ্জুষাকে বলে,’এবার তুমিই হবে আমার প্রেমের কবিতার উপজীব্য ।’
হেসে বিনয়ের সুরে মঞ্জুষা বলে,’সে দরকার নেই। তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়ে লেখো। আমি তো তোমার হৃদয়লীনা।’
এরপর অরুণাভ কীভাবে ভাবতে পারে মঞ্জুষা কখনো ওকে ছেড়ে চলে যাবে? সে তো মঞ্জুষার কথাতেই পরিষ্কার।এভাবে চলল চার-চারটে বছর।
তারপর একদিন মঞ্জুষা সাবলীলভাবে ওকে বলল,’আজো তোমার কিছু হল না। খুব নামী কবি হয়ে উপার্জন করছ তাও নয় তাই বাবাকে কি করে ঠেকাই। বাবা এক স্কুল-শিক্ষককে আমার হবু-স্বামী হিসাবে ঠিক করেছে । আমি কি আর না করতে পারি ?’
অরুণাভ তারপর আর কোন কথা শুনতে চায়নি মঞ্জুষার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওকে বলে শুধু,’তুমি যা ভাববে। আমি এখানে বলার কে ? তোমার মঙ্গল হোক ।’
কিন্তু বড্ড আঘাত পেয়েছিলো অরুণাভ । মানসিক দিক থেকে একেবারে বিপর্যস্ত । শেষমেশ ওর মধ্যে চূড়ান্ত পাগলামি দেখা দিল।
অরুণাভর বাবা আত্মীয়-বন্ধুদের কথা শুনে অরুণাভকে এক মানসিক রোগীর হাসপাতালে ভর্তি করে দিল।
সেই খবর মঞ্জুষাও জেনে যায় সদ্য গড়া বরের ঘরে থেকে। ওর বোন মঞ্জুলা ওকে ফোনে সব জানায়। তবে মঞ্জুষা তেমন হেলদোল দেখায়নি।
ও বোনকে বলে,’রোগ আছে, তার ওষুধ আছে। ভালো হয়ে যাবে নিশ্চয়।’
দিদির কথা শুনে বেশ অবাক হয় মঞ্জুলা ।
ওকে বলে,’প্রেম ছিল না তোর সাথে ? অমন করে বলতে হয় বুঝি ?’
‘ধুস’ বলে মঞ্জুষা হাসতে হাসতে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায় তখন।
দু’মাস পরে অরুণাভ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। মোটামুটি সুস্থ ও। ওকে ফিরে পেয়ে বাড়ি থেকে বাড়ির বাইরে সবাই খুশি ।
বন্ধুরা ওকে বলে,’নামী-টামি কিছু হতে হবে না তোকে। কবিতা লেখা কিন্তু ছাড়বি না। তোর পরিচয় প্রেমিক হিসাবে নয় । শুধুই কবি হিসাবে ।’
একটু ধাতস্থ হয়ে অরুণাভ আবার কবিতা লিখতে শুরু করলো। এবার আর প্রেম-প্রকৃতি কিছু নয় । শুধু নিজেকে নিয়ে ঘুরেফিরে।
অরুণাভ একটা কবিতায় লিখল-
‘আমি শান্ত হয়ে গেছি বড়
কল্পপুরের রাস্তা কোনদিকে ভুলে গেছি আজ
দেহের পিয়াস খোলা জানলা দিয়ে ফেলে দিয়েছি নয়ানঞ্জুলিতে
বড় বেশ আছি এখন মেঘের খেয়ায়
শুধুই নিরন্তর নিজের জন্য বৃষ্টির আরাধনায়।
কবিতার একেবারে নীচের দিকে মনের খেয়ালে লিখল ইয়েটসের কবিতা এক চরণ–
Myself I must remake .’
ওর কিছু বন্ধু সে কবিতা পড়ে চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। শান্ত নামে স্বভাবে অশান্ত বন্ধু আকাশ-পাতাল ভেবে-ভেবে শেষে বলল,’বোঝা গেলো বেমক্কা পিরিতির চূড়ান্ত পরিণতি। আজ থেকে বুঝি আমাকেও ভাবতে হচ্ছে।’
বাকি বন্ধুরা সাথে-সাথে একসাথে বলে বসলো,’আমরাই বা কেন বাদ যাবো ? আমরাও তবে ভাবছি ।’
বন্ধুদের কথা শুনে সারা মুখে উজ্জ্বল-হাসি নিয়ে বলল,’এক ঘটনা কি সবার হৃদয় ছিন্ন করতে পারে ? ভেবে দেখ তোরা । তবে পায়ের তলার মাটি আগে। এখানে সৃষ্টির এক অক্ষরও কাজে আসে না।’
বলেই অরুণাভ ঘরের খোলা জানলা সদ্য শুরু হওয়া বসন্তের হৃদয় ঝিম-ধরা আকাশের দিকে অপলকে চেয়ে থাকলো । মুখে একফোঁটা হাসি নেই ওর । শুধু মুখের রেখায়-রেখায় নাচছে তখন নানা প্রশ্ন।।