প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৯ আগস্ট : ’আমার ভয় লাগছে।আমাকে একটু জল দাও। আমার মা কে আসতে বলো!থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে আমার ছেলে নাসিম আক্তারের কাছে এই অনুরোধ রেখেছিল অনেক স্বপ্ন নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রটি ।আমার ছেলে ওই ছাত্রটির পাশে দাঁড়িয়েছিল।সেটাই বোধহয় অপরাধ হয়ে গিয়েছে।যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাায় পুলিশ শুক্রবার রাতে নাসিমকে গ্রেপ্তারের পর এমনটাই দাবি করলেন তাঁর বাবা সেখ নাসির হায়দার।একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন,’প্রকৃত দোষিদের আড়াল করতে আমার নির্দোষ ছেলেকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হল’।
নাসির হায়দারের এইসব দাবি যদিও আদালতে মান্যতা পায়নি।বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার হওয়া নাসিম আক্তার,সত্যব্রত রায় ও হিমাংশু কর্মকার কে শুক্রবার আলিপুর আদালতে পেশ করা হয় । সরকারী আইনজীবী ধৃত এই তিনজনের জামিনের বিরোধীতা করে আদালতে জানান,“ধৃতরা সফল অপরাধী-কিন্তু ব্যর্থ অভিনেতা“। সওয়াল পর্ব শেষে বিচারক নাসিম আক্তার সহ তিনজনকেই ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত পুলিশ হেপাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
নাসিম আক্তারের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের মেমারি থানার বারারী গ্রামে।তার বাবা মহসিন হায়দার চাষবাস করেন।গ্রামের বারারিডিহি পলাশ সপ্তপল্লী শিক্ষানিকেতন থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর খড়গপুর আলামিন মিশনে ভর্তি হয় নাসিম।উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনার জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় নাসিম। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের তিন তলার ৭৩ নম্বর রুমে নাসিম থাকতো।বর্তমানে সে স্নাতোকোত্তর স্তরের সদ্য প্রাক্তনী।৯ আগষ্ট রাতেও সে হ্টেলেই ছিল । ১০ আগষ্ট সকালে নাসিম বারারি গ্রামে নিজের বাড়ি ফিরে যায়।মানবাধিকার কমিশনে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালের হস্টেল সুপার বৃহস্পতিবার নাসিমকে আসতে বলেন। পরে যাদবপুর থানা থেকে ফোন করেও নাসিম কে ডেকে পাঠানো হয়। শুক্রবার সকালে বাবা নাসির হায়দারের সঙ্গে নাসিম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যান।পরে সেখানকার থানাতেও যায়। টানা জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ নাসিম আক্তার কে গ্রেপ্তার করে । নাসিমের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর গ্রামে পৌছাতেই সবাই সম্ভিত হয়ে যান ।
ছেলে নাসিমকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে জেনে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন মা নূরজাহান আক্তার ।তিনি স্বাস্থ্যকর্মী। শনিবার বেলায় নাসিমদের বাড়িতে পৌছে দেখা যায় ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে নূরজাহান আক্তার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নবম শ্রেণীর পড়ুয়া নাসিমের বোন সায়েরী আক্তার তাঁর মা কে সান্তনা দিয়ে চলেছে । শুধু পরিবার পরিজনই নয় ,প্রতিবেশীরাও সকলে দাবি করেন,নাসিম খুব ভালো ছেলে। যাদবপুর কাণ্ডে নাসিম জড়িত এইকথা তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না। স্থানীয় বড়পলাশন ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য বসিরউদ্দিন ইসলাম সেখ বলেন,“নাসিম ছেলে হিসেবে খুবই ভালো। কি করে ওর নাম জড়ালো বুঝতে পারছি না“। গ্রামের বাসিন্দা নূর ইসলাম মণ্ডল বলেন, ’ছেলেকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে বাবা মহসিন হায়দার কার্যত সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছেন’।
নাসিম আক্তারের বাবা মহসিন হায়দার এদিন বাড়িতে ছিলেন না। তিনি শুক্রবার থেকে কলকাতাতেই রয়ে আছেন। ফোনে যোগাযোগ করা হলে মহসিন হায়দার দাবি করেন,প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে আমার নির্দোষ ছেলেকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হল। পাশাপাশি তিনি এও বলেন,’পরীক্ষা শেষে আমার ছেলে নাসিম বাড়িতে চলে এসেছিল। হস্টেল ক্লিয়ারেন্স ও গোটপাস নেবার জন্য ছেলে নাসিম ৭ তারিখ হস্টেলে যায়। আমার ছেলের সাথে প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রের পরিচয় ছিল না । ৯ তারিখ রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে আমার ছেলে নাসিম যখন ওয়াশরুমে যাচ্ছিল তখন সে হোস্টেলের বারান্দায় ওই ছাত্রটিকে দেখতে পায় ।
ছাত্রটি তখন বারান্দায় দাড়িয়ে কাঁদছিল,এমনকি থরথর করো কাঁপছিল । তা দেখে আমার ছেলে কি হয়েছে তা ওই ছাত্রটির কাছে জানতে চায় । তখন ছাত্রটি আমার ছেলে নাসিমকে বলে ,’আমার ভয় লাগছে।আমাকে একটু জল দাও। আমার মা কে আসতে বলো!’ নাসিম জল এনে খাওয়ায় ছাত্রটিকে। বাথরুম যেতে চাইলে হস্টেলের অপর সিনিয়র আবাসিক আসিফ তাকে বাথরুমে নিয়ে যায় । আর কাশ্মীর থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা অপর সিনিয়র আবাসিক আরিফ ফোন ধরিয়ে দিলে ছাত্রটি তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলে মহসিন হায়দার জানান’। এই ঘটনার পরদিন নাসিমের বাড়ি চলে আসার কারণ প্রসঙ্গে মহসিন হায়দায় বলেন,’আমার বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েই ১০ তারিখ সকালে নাসিম বাড়ি চলে এসেছিল । বাড়ি ফিরে এসে নাসিম আমাদেরকে স্বপ্নদীপকে সাহায্য করা ও ওইদিন তার অবস্থার কথা জানিয়েছিল’।।