জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী : খেলার জগত বা রাজনীতির জগত অথবা অন্য যে কোনো জগতে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন যাদের সরব বা নীরব উপস্থিতি ম্যাজিকের মত কাজ করে।বিপক্ষকে চাপে ফেলে দেয়। রাজনীতিতেও এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যাদের চোখে না দেখলেও কেবল নাম শুনেই সাধারণ মানুষের মনে তার সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ইমেজ গড়ে ওঠে। তার লড়াকু ভাবমূর্তি দলের মধ্যে, মানুষের মধ্যে একটা আলাদা প্রভাব ফেলে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত বাঁকুড়া জেলায় তৃণমূলের সুজাতা মণ্ডলের মধ্যে হয়তো তাদের সেই ‘ডেয়ারডেভিল’ নেত্রীকে পেয়ে গেছে যিনি সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন ।
পেশায় শিক্ষিকা সুজাতার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ খুব বেশি দিনের নয়। এইতো সেদিন ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে এক গৃহবধূকে বিজেপির প্রচার মঞ্চে দেখে বাঁকুড়ার সাধারণ মানুষ চমকে ওঠে। একশ্রেণির ‘তোলামূলী’ তৃণমূল নেতার সৌজন্যে তৃণমূল যথেষ্ট ব্যাকফুটে। তার উপর এইরকম এক নেত্রীর সহজ সরল বক্তব্য মানুষের মনে বেশ প্রভাব ফেলে । লোকসভা ভোটে সংশ্লিষ্ট আসনের ফলাফল সবার জানা।
পরে সুজাতার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ। বিজেপি ত্যাগ করে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে অভিষেকের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেন। তৃণমূলে তখন চরম দুর্দিন। একের পর এক প্রথম সারির নেতা ‘কিছু পাবার আশায়’ দলত্যাগ করে বিজেপিতে নাম লেখাচ্ছে। কিন্তু সুজাতা হাঁটল স্রোতের বিপরীতে।
আরামবাগ কেন্দ্রে দলের হয়ে প্রার্থী হয় সুজাতা। ভোটের দিন প্রায় শ’দুয়েক লোকের আক্রমণের মুখে পড়তে হয় তাকে। টিভির পর্দায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দেখছে একদল বীরপুঙ্গব(!) লাঠি নিয়ে এক মহিলাকে তাড়া করছে। চমক ভাঙার আগেই তার মাথার উপর পড়ছে লাঠির আঘাত। জীবন বিপন্ন হতে পারত! যেকোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ ভক্ত ছাড়া কেউই একজন মহিলার উপর, যতই সে বিপক্ষ দলের প্রার্থী হোক, আঘাত মেনে নেবেনা। তার উপর সহানুভূতি ঝরে পড়লেও ভোটে সুজাতা হেরে যায়। অনেকেই ভেবেছিল এবার হয়তো সে ফিরে যাবে নিজের জগতে। ঘটল বিপরীত ঘটনা। নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।
আরামবাগের ঘটনার পর তার আর এক লড়াইয়ের সাক্ষী থাকল বাঁকুড়া তথা রাজ্যবাসী। তার উদ্দেশ্যে নেমে এল চরম কুৎসা। ব্যক্তিগত আক্রমণ সব সীমা অতিক্রম করে গেল। ঘটনার গভীরে না গিয়ে ‘ব্রাইডাল মেকাপ’ নেওয়া সুজাতাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়ে তার নতুন ‘স্বামী’ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল একশ্রেণির মিডিয়া। যেকোনো নারীর কাছে সেটা চরম অপমানের, লজ্জার। প্রতিদিন মিডিয়ার হেডলাইনে সুজাতার নাম। ভেঙে না পড়ে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েন তিনি ।
এবার দল তাকে জেলাপরিষদের প্রার্থী করে। একে হারা আসন, তার উপর বাঁকুড়ায় বিজেপির দাপট। বিগত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের ফল সেই দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু ‘হার না মানা’ মানসিকতা নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে রইল সুজাতা। কোণঠাসা তৃণমূল কর্মীরা তাকে কাছে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রচারের ময়দানে। যে বিজেপি নেতৃত্ব ভেবেছিল চেনা পরিবেশে জয় সহজ হবে, ভোটের ফল বের হওয়ার পর দেখল তাদের গলায় পরাজয়ের মালা।
এবার বাঁকুড়ার বাতাসে অন্য গন্ধ। হতোদ্যম তৃণমূল কর্মীদের মনে উচ্ছ্বাসের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে সুজাতা। অন্যদিকে বিজেপির মনে আতঙ্ক। তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে সেটা বিজেপির বিরুদ্ধে যেতে পারে। তৃণমূল যদি তাকে জেলা পরিষদের সভাধিপতির পদ দেয়, যার সম্ভাবনা বেশি, তাহলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির লড়াইটা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। মুখে স্বীকার না করলেও সাধারণ মানুষের মত বিজেপিও বিশ্বাস করে সেক্ষেত্রে সুজাতার হাত ধরে বাঁকুড়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া পাবেই। ‘ফাইট সুজাতা ফাইট’ পৌঁছে যাবে লোকের দুয়ারে দুয়ারে। তৃণমূল কর্মীরা এরকম একজন নেতৃত্বকে পাশে পেয়ে উৎসাহ পাবে। সেক্ষেত্রে লোকসভার দুটি আসনই বিজেপির হাতছাড়া হতে পারে। সুজাতার আগমনে বিজেপি আতঙ্কিত। বাঁকুড়ায় কান পাতলে টের পাওয়া যাবে। আসলে বাঁকুড়ায় সব থাকলেও দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মত সর্বজনগ্রাহ্য কোনো জেলা নেতা তৃণমূলের নাই। যারা আছে তাদের জনপ্রিয়তা নিজ নিজ এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
এখন দেখার দল সুজাতাকে জেলাসভাধিপতির পদ দিয়ে তার ‘ফেস ভ্যালু’ ব্যবহার করে লোকসভা ভোটে বাঁকুড়ায় নিজেদের ‘ব্রাণ্ড ভ্যালু’ বাড়িয়ে নেওয়ার মত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কিনা? সেক্ষেত্রে লোকসভা ভোটে বাঁকুড়ার দুটি আসনই তৃণমূলের পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। যদিও ইতিমধ্যে আরও দু’তিনটি নাম বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাঁকুড়া তৃণমূলের নীচু তলার কর্মীদের একটা বড় অংশের সমর্থন সুজাতার প্রতি থাকলেও দলের পরিবর্তে যারা নিজের স্বার্থে রাজনীতি করে তৃণমূলের সেইসব নেতারা কি সহজে বিষয়টি মেনে নেবে ?