জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,আউশগ্রাম(পূর্ব বর্ধমান), ২৯ জুন : গত বিধানসভা ভোট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ৭ টি অঞ্চল বিশিষ্ট আউশগ্রাম-১ বিধানসভায় তৃণমূল ৩ টি অঞ্চলে এবং বিজেপি ৪টি অঞ্চলে জয়লাভ করে। বুথ হিসাবে তৃণমূল ৬৪ টি এবং বিজেপি ৬৮ টি বুথে জয়লাভ করে। যদিও বিধানসভা ও পঞ্চায়েত ভোটের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা । প্রথমটায় রাজ্যের প্রসঙ্গ এলেও দ্বিতীয়টিতে স্থানীয় এলাকার সমস্যা ও নেতাদের আচরণ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়।
পঞ্চায়েত ভোট গ্রামীণ এলাকার ভোট। এখানে মানুষ বিরিয়ানি দাবি করেনা। তার দরকার নুন্যতম চাহিদা যেমন রাস্তার উন্নতি, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রাপ্য বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা, সঠিক সময়ে জাতিগত শংসাপত্র, পানীয় জল, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ইত্যাদি। গ্রামের সরল সাধাসিধে মানুষ চায় শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্ব যেন আপদে বিপদে তাদের পাশে থাকে ও ভাল আচরণ করে। অঞ্চল সভাপতি বা পঞ্চায়েত প্রধান বড় বাড়ি বা সম্পত্তি কি করে করল সেটা নিয়ে মানুষ সব সময় মাথা ঘামায় না ।
২০১৮ সালে সন্ত্রাস তথা আতঙ্কের পরিবেশে ভোট হতে না দেওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদল তৃণমূল এই ব্লকের ৭ টি অঞ্চলেই ক্ষমতা দখল করে। একই সঙ্গে পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদেও নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখে। যেহেতু ভোট হয়নি তাই জনগণের কাছে দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতাদের গ্রহণযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়নি। প্রথম সুযোগেই অর্থাৎ প্রথমে লোকসভা ও পরে বিধানসভা ভোটে তাদের একাংশ কতটা যোগ্য বা জনপ্রিয় প্রমাণ হয়ে যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত দুটি ভোটেই তৃণমূল প্রার্থী জয়লাভ করে। এবার তৃণমূল বিরোধী বিজেপি ও সিপিএম মিলিতভাবে, ব্যতিক্রম বিল্বগ্রাম,পঞ্চায়েতের সব আসনে প্রার্থী দিয়েছে । সুতরাং লড়াই অনিবার্য ।
বিধানসভা ভোটে যে ৪ টি অঞ্চলে তৃণমূল হেরেছিল ইতিমধ্যে তাদের অন্যতম বিল্বগ্রাম অঞ্চল তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে নিয়েছে। স্থানীয় নেতাদের উদ্ধত আচরণের জন্য এবার বেশ কয়েকটি অঞ্চলে তৃণমূল চাপে আছে । দিগনগর -২ বা আউশগ্রাম অঞ্চলে বিরোধীরা যথেষ্ট এগিয়ে আছে। এলাকায় কান পাতলেই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে এসব কথা শোনা যাবে। অথচ এরাই আবার বিধায়কের কাজে খুশি । তার নমুনা ‘দিদির দূত’ কর্মসূচির সময় অনেকের নজর এড়িয়ে যায়নি।
সার্বিকভাবে উন্নতি হলেও কিছু এলাকায় রাস্তার পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ। এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতারা বেহাল রাস্তা ধরে যাতায়াত করলেও এলাকাবাসীর অভিযোগ,রাস্তা মেরামত করার জন্য তাদের সক্রিয় উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এমনকি অভিযোগ জানানোর জন্য নেতাদের কাছেও পাওয়া যায়নি । এলাকায় জনসংযোগের ঘাটতি তৃণমূলকে পেছিয়ে দিয়েছে। যদিও এইসব অভিযোগ বিরোধীদের অপপ্রচার বলে তৃণমূল নেতৃত্ব উড়িয়ে দিয়েছে। বেহাল রাস্তা বেহাল থেকে গেছে। বাস্তবে কে কবে নিজের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ স্বীকার করেছে ? ভোট যন্ত্রে এর প্রভাব পড়বে।
এলাকায় কান পাতলে আবাস যোজনার বাড়ি নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ শোনা যায়। অনেক যোগ্য প্রাপকের নাম নাকি তালিকা থেকে বাদ গেছে। পরিবর্তে নাম এসেছে অন্যদের। বাড়ি তৈরি করতে গেলে কাটমানি তো দিতেই হয় বলে অভিযোগ ।
পাশাপাশি একশ্রেণির তৃণমূল নেতার উদ্ধত আচরণ স্থানীয় বাসিন্দাদের যথেষ্ট ক্ষুব্ধ করে তুলেছে । অভিযোগ,নেতারা এলাকার বাসিন্দাদের তাদের চাকরবাকরের মত আচরণ করে । দরকার হলে তাদের বাড়িতে বা দলীয় অফিসে এসে বাসিন্দারা তাদের সমস্যার কথা বলবে। কিন্তু তারা এলাকায় যাবে না । এরসাথে তোলাবাজির অভিযোগ তো আছেই ।
যে দুটি অঞ্চল তৃণমূলের হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাদের অন্যতম হলো আউশগ্রাম অঞ্চল। বিধানসভার নিরিখে সেখানে তৃণমূল প্রায় ৮০০ ভোটে পেছিয়ে আছে। এখানে ১৩ টি বুথে বিজেপি ও ৯ টি বুথে জেতে তৃণমূল । তার উপর একসময় তৃণমূলের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা চন্দ্রনাথ ব্যানার্জ্জীর (চাঁদুদা), বর্তমানে বিজেপি নেতার উপর অযথা আক্রমণ সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। এই ঘটনা ভোটের উপর প্রভাব ফেলবেই। যতই তৃণমূল নেতৃত্ব অস্বীকার করুক এলাকায় চাঁদুবাবুর বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি ।
দীগনগর -২ নিশ্চিত পরাজয়ের হাতছানি দিচ্ছে তৃণমূলকে। বিধানসভা ভোটে এখানে মাত্র ১ টি মাত্র বুথে জেতে তৃণমূল, বিজেপি ৮ টি বুথে। প্রায় ১২০০ ভোটে বিজেপি জয়লাভ করে। শোনা যায় তৃণমূল নেতৃত্ব নাকি এলাকায় জনসংযোগ করেনি। স্বাভাবিক কারণে মানুষের কাছ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে শাসকদল ।
এলাকায় সিপিএম বা বিজেপি প্রার্থী দিলেও কতটা তারা এককভাবে বা কতটা পৃথকভাবে লড়াই করছে সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। পরিস্থিতি অনেকটা ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের মত। শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ অমান্য করে সেদিন সিপিএমের অত্যাচারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কংগ্রেস, বিজেপি ও তৃণমূল কার্যত যৌথভাবে লড়াই করেছিল এবং ফলও পেয়েছিল । এবারও পরিস্থিতি ঠিক অনেকটা সেইরকম। ভোটের ফল বের হওয়ার পর বিজয়ী প্রার্থীদের কে কোন দলে থাকবে সেটাও ভাববার বিষয় । এটাও ভাববার বিরোধী দলের প্রার্থীদের কতজন মনেপ্রাণে তৃণমূল বিরোধী।
বাস্তবে এখানে বিজেপির সংগঠন বলে কিছু নাই। বিশেষজ্ঞদের মতে বিধানসভা ভোটে সিপিএমের লোকজন বিজেপিকে ভোট দেয় বলে বিজেপিকে ভদ্রস্থ লাগে। এবার সেই ভোট সিপিএমের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেটা হলে ঘাসফুল শিবিরে নিশ্চিত চিন্তার ভাঁজ পড়বে। মাথায় রাখতে হবে আদিবাসী অধ্যুষিত আউশগ্রাম একদা লালদূর্গ ছিল । যদিও তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের দাবি জয় তাদের হবে। লোকে উন্নয়নের পক্ষে, লক্ষীর ভাণ্ডারের পক্ষে ভোট দেবে । তবে নেতাদের উদ্ধত আচরণের বিরুদ্ধেও যে ভোট দিতে পারে সেটা তাদের মাথায় নাই । জয়ের দাবি করছে বিরোধীরাও । তাদের দাবি সন্ত্রাস না হলে জয় তাদের হবেই। কিন্তু মানুষ কেন তাদের ভোট দেবে সেবিষয়ে নীরব। চৌত্রিশ বছর ধরে রাজত্ব করলেও সিপিএম বিকল্প কর্মসূচি মানুষের সামনে রাখতে পারেনি ।
বাস্তবে আউসগ্রাম-১ ব্লকে তৃণমূল নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী । এখন দেখার বিধায়কের জনপ্রিয়তা, এলাকার উন্নয়ন বনাম স্থানীয় নেতৃত্বের আচরণ – জয় কার হয় ।।