এইদিন ওয়েবডেস্ক,কাটোয়া(পূর্ব বর্ধমান),১০ এপ্রিল : টানা ৫ বারের বিধায়ক । চার বার কংগ্রেসের, একবার তৃণমূলের । দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক ধরে কাটোয়ার বিধায়ক রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় । এবার কি এই ধারায় ছেদ পড়তে চলেছে ? কারন বিগত ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া বিধানসভায় খারাপ ফল করেছে শাসকদল । উঠছে অনুন্নয়ন ও দুর্নীতির অভিযোগও । এদিকে এই সমস্ত অভিযোগগুলোকে ইস্যু করে নিজেদের পায়ের তলার মাটি একটু একটু করে মজবুত করে ফেলেছে গেরুয়া শিবির । পাশাপাশি বিধায়ক বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাদের একটা অংশ আজ বিজেপিতে । বর্তমানে সাংগঠনিক ক্ষমতায় কাটোয়ার শাসকদলকে টেক্কা দিচ্ছে বিজেপি । তাহলে কি বিজেপির দাপটে একুশে অস্তাচলে যেতে চলেছে তৃণমূলের রবি ? এনিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়ে গেছে কাটোয়ার রাজনৈতিক মহলে ।
কাটোয়া-১ ও ২ ব্লক, কাটোয়া ও দাঁইহাট পুরসভা নিয়ে কাটোয়া বিধানসভা এলাকা ।১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বার এখানে বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় । শুরু থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের বিধায়ক ছিলেন । তারপর ২০১৫ সালে দল বদল করে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন । পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে লড়াই করে ভোটে জেতেন রবীন্দ্রনাথবাবু । এদিকে কাটোয়া পুরসভা তৃণমূলের দখলে তো ছিলই, পরে সিপিএম শাসিত দাঁইহাট পুরসভারও দখল নেয় শাসকদল । বিধায়ক থাকার পাশাপাশি ২০১৫ সাল থেকে কাটোয়া পুরসভার দায়িত্বে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ।
পূর্ব বর্ধমানে বিজেপির সাংগঠনিক কাটোয়া জেলার সভাপতি কৃষ্ণ ঘোষের অভিযোগ, ‘দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক ধরে বিধায়ক ও প্রায় ৬ বছর পুরসভার চেয়ারম্যান থাকার পরেও সেভাবে এলাকার উন্নয়ন করেননি রবীন্দ্রনাথবাবু । কাটোয়া বিধানসভা এলাকায় ভাগীরথীর তীরবর্তী গ্রামগুলির প্রধান সমস্যা ভাঙন । প্রতি বছর বর্ষায় গ্রামগুলিকে একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে ভাগীরথী ৷ অথচ নদীর পাড় সংস্কারের কোনও উদ্যোগই নিতে দেখা যায় না বিধায়ককে । কিন্তু বর্ষা এলেই তখন তাঁর ভাঙনের কথা মনে পড়ে । কাটমানির লোভে শুরু হয় লোক দেখানো নদীর পাড় মেরামতির কাজ । এছাড়া গ্রামীন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির অবস্থা খুবই খারাপ । সেই কারনে এলাকার গরীব মানুষদের কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয় । কিন্তু হাসপাতালের সঙ্গে স্থানীয় নার্সিংহোমগুলির আর্থিক চুক্তি আছে । তাই প্রসূতি বা মূমূর্ষু রোগিদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনলেই কমিশনের লোভে রোগীদের নার্সিংহোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । এই হল কাটোয়ার সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা । শুধু চিকিৎসা পরিষেবাই নয় এখানের শিক্ষা ব্যাবস্থা,রাস্তা-ঘাটের অবস্থাও খুবই নিম্নমানের ।’ তাঁর কথায়, ‘এখানে আবাস যোজনার অনুদান পেতে গেলে কাটমানি দিয়ে হয় । এমনকি গঙ্গার ঘাটের কাছে ও পুরসভার পাশে একটি করে যে দুটি পার্ক করা হয়েছে তাতেও দূর্নীতি হয়েছে । আমফানের ত্রাণের অনুদান বিলিতে দূর্নীতি,করোনা কালে রেশন সামগ্রীতে দূর্নীতি, এখানে সবেতেই দূর্নীতি ।’
অন্যদিকে বিজেপির জেলা সভাপতির তোলা দুর্নীতির অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন কাটোয়ার তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় । তিনি আমফান নিয়ে দূর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কেন্দ্র সরকার আমফানের ত্রানে প্রথমে ১০০০ কোটি টাকা দিয়েছিল । তারপর অনেক পরে আরও ১৭০০ কোটি টাকা দেয় । এদিকে আমফানের ত্রাণের জন্য রাজ্য সরকার ৬০০০ কোটি টাকা খরচ করেছে ৷ কেন্দ্র সরকার ত্রাণের জন্য সেভাবে টাকাই তো দিতেই পারল না । টাকা দিলে তবে তো দূর্নীতির অভিযোগ তুলবে ৷’ সেই সঙ্গে কাটোয়ায় ভাগীরথী তীরবর্তী গ্রামগুলির ভাঙন প্রসঙ্গে বর্ষীয়ান এই তৃণমূল নেতা বলেন, ‘ভাগীরথীর পাড় সংস্কার কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় । এলাকার ভাঙন অধ্যুষিত গ্রামগুলির পাড় সংস্কারের জন্য আমরা বহুবার কেন্দ্র সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি । কিন্তু কোনও লাভ হয়নি । তাই রাজ্য সরকার তার সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে যেটুকু পারে ভাগীরথীর পাড় সংস্কারের চেষ্টা করে ।’
এদিকে দুর্নীতি ছাড়াও কাটোয়ার তৃণমূলের বিধায়কের বিরুদ্ধে অনান্য বিষয়েও সরব হতে দেখা যায় বিজেপির জেলা সভাপতি কৃষ্ণ ঘোষকে । তাঁর অভিযোগ, ‘৫ বারের বিধায়ক কেবল ভোটের সময় এলাকায় ঘোরেন । তারপর আর কোনও কাজেই তাঁকে দেখা যায় না ।’ পাশাপাশি শাসকদলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করে পুরসভা ও পঞ্চায়েত দখল করার অভিযোগ তুলে কৃষ্ণবাবু বলেন, ‘আজ কাটোয়ার আনাচে কানাচে কান পাতলেই শুনতে পাবেন এলাকার মানুষ বিধায়কের কাজকর্মে কতটা বীতশ্রদ্ধ । মানুষ ওনাকে সরাতে চাইছেন ৷ তাই বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন কাটোয়াবাসী । বিগত নির্বাচনগুলিতেই তার প্রতিফলন দেখা গেছে।’
যদিও বিজেপির জেলা সভাপতির তোলা এই সমস্ত অভিযোগগুলি অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন, ‘বিগত ৫ বছরে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি । সেই উন্নয়নের ছোঁওয়া ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে । অন্যদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোনও প্রতিশ্রুতিই পালন করেনি । ওরা দেশের সব কিছু বেচে দিচ্ছে । এই কারনে বিজেপিকে আর বিশ্বাস করছেন না সাধারন মানুষ । তাই এবারেও মানুষ তৃণমূলের উপরেই আস্থা রাখবেন । এবারে নুন্যতম দশ হাজার ভোটে আমি জিতব বলে আশা করছি ।’
তবে রবীন্দ্রনাথবাবু যাই দাবি করুন না কেন ২০১৬ সালের বিধানসভা ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে তাঁর পক্ষে মোটেই সুখকর নয় বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল । ২০১১ সালেও কাটোয়া শহর থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ব্যাপক ভোটে জিতেছিলেন রবীন্দ্রনাথবাবু । তখন জয়ের ব্যাবধান ছিল প্রায় ১৮ হাজার । কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী শ্যামা মজুমদারের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর হয় । শেষ পর্যন্ত মাত্র ৯১১ ভোটে তিনি জয় হাসিল করেন । তখন রবীন্দ্রনাথবাবু পেয়েছিলেন ৯১৪৮৯ টি ভোট । কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামা মজুমদারের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৯০৫৭৮ । তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপির প্রার্থী অনিল দত্ত ১৪,৯১৭ টি ভোট পেয়েছিলেন ।
এরপর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে বর্ধমান পূর্ব লোকসভার অন্তর্গত কাটোয়া বিধানসভা এলাকায় আরও খারাপ ফল করে তৃণমূল । লোকসভা তৃণমূলের দখলে থাকলেও কাটোয়া বিধানসভা এলাকায় বিজেপির থেকে ১৮৫৯ ভোটে পিছিয়ে পড়েছিল শাসকদল । সব থেকে খারাপ ফল ছিল কাটোয়া শহর এলাকায় । কাটোয়া পুরসভার ২০ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪ টিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি । বিগত লোকসভায় বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী পরেশচন্দ্র দাস কাটোয়া বিধানসভা এলাকা থেকে ৮৯,১৭৫ টি ভোট পেয়েছিলেন । অন্যদিকে তৃণমূল প্রার্থী সুনীল কুমার মণ্ডল কাটোয়া থেকে পেয়েছিলেন ৮৭,৩১৬ টি ভোট।
শুধু বিগত দুই নির্বাচনে খারাপ ফলাফলই নয়,গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত তৃণমূলের ভাঙন রুখতে সক্ষম হয়নি শীর্ষ নেতৃত্বও । বিধায়কের সঙ্গে বিবাদের জেরে কাটোয়া পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান অমর রাম ইতিমধ্যে তাঁর দুই অনুগামী কাউন্সিলারকে নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন । সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পুরনো দলের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার পর বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূলের সাংসদ সুনীল কুমার মণ্ডলও । আর এদিকে কাটোয়ায় সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী নিয়েও কংগ্রেস-সিপিএমের মধ্যেও টানাপোড়েন চলছে । দু’দলের তরফ থেকেই প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছে । এই বিবাদের ফায়দা বিজেপির ভোটবাক্সেই পড়বে বলে দাবি বিজেপির জেলা সভাপতি কৃষ্ণ ঘোষের । তাঁর কথায়, ‘বামের ভোট রামের ঘরেই যাবে ।’
এছাড়া বিগত বিধানসভা নির্বাচনে রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রধান প্রতিপক্ষ বর্ষীয়ান নেত্রী শ্যামা মজুমদারও ‘হাত’ ছেড়ে ‘পদ্ম’ শিবিরে নাম লিখিয়েছেন । সেই শ্যামাদেবীকেই এবারে প্রার্থী করেছে বিজেপি । তাই কাটোয়ার তৃণমূল প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এবারের লড়াইটা মোটেই সহজ হবে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল । কাটোয়ার বিজেপি প্রার্থী শ্যাম্যা মজুমদার বলেন, ‘প্রতিপক্ষর সঙ্গে লড়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার আছে । তাই এনিয়ে আমি চিন্তিত নই । কাটোয়ায় আমি নিশ্চিতভাবে জিতব ।’।