প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৯ মে : জন্মের সময় থকেই দুটি হাত থেকেও যেন নেই । খর্বকায় দুটি হাতে নেই তালু, নেই আঙুলও।কিন্তু তাতে আর কি যায় আসে।শিক্ষক হবার স্বপ্নে বিভোর জগন্নাথ মাণ্ডি পা দিয়ে লিখেই এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল।পরীক্ষা দিয়ে পাস করার ব্যাপারেও দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিল জগন্নাথ । আর সেটাই হয়েছে। শুক্রবার মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হবার পর জগন্নাথ জানতে পারে সে ২৫৮ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে ।বিশেষ ভাবে সক্ষম দরিদ্র আদিবাসী পরিবারের এক ছাত্রের এই সাফল্যকে কুর্নিশ না জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সহ এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষজন ।
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী জগন্নাথ মাণ্ডির বাড়ি পূর্ব বর্ধমাণের মেমারি থানার সিমলা গ্রামের আদিবাসী পাড়ার।তাঁর শৈশব জীবন খুব একটা সুখের ছিল না । ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মেছে জেনেও ছোট বেলাতেই তাঁকে ছেড়ে চলে যায় মা । তবে মা ছেড়ে চলে গেলেও বাবা, বৃদ্ধা ঠাকুমা এবং পিসি ও দাদার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি জগন্নাথ । এঁনাদের পরম স্নেহে জগন্নাথ লালিত পালিত হয়। এঁনারা লেখাপড়া শেখার প্রতি জগন্নাথকে ছোট বয়স থেকেই আগ্রহী করে তোলেন। ভর্তি করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন থেকেই পা দিয়ে বাংলায় লেখা রপ্ত করতে শরু করে জগন্নাথ । সময় গড়ানোর সাথে সাথে জগন্নাথ পা দিয়ে লেখাতে সাবলীল হয়ে ওঠে ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পূর্ণ হলে পরিবারের লোকজন জগন্নাথকে ভর্তি করে মেমারির নুদীপুর ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে।সেখানে একের পর এক ক্লাসে উত্তির্ণ হয়ে জগন্নাথ এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। জগন্নাথই ছিল সিমলা আদিবাসী পাড়া থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া একমাত্র ছাত্র। তাই জগন্নাথের মত পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা দিতে যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য সব রকম সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পরীক্ষাকেন্দ্র মেমারির বাগিলা পূর্ণচন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের পরীক্ষকরা।
এদিন রেজাল্ট বের হবার পর নুদীপুর ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের শিক্ষকরাও জগন্নাথের ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রধান শিক্ষক কিশোর ঘোষাল বলেন,’জগন্নাথ খুব ভালো ছেলে।লেখা পড়ার ব্যাপারেও ও খুব সচেতন।ওর ব্যবহার মুগ্ধ করে স্কুলের সকল শিক্ষক ও সহপাঠীদের। কিশোরবাবু আরো বলেন,জগন্নাথ অত্যন্ত দুর্বল আর্থিক পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে ছোট বয়স থেকেই ওর বৃদ্ধা ঠাকুমা ওকে অনুপ্রাণিত করে যান।সেই প্রেরণায় শত কষ্টের মধ্যেও জগন্নাথ লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এ বছর এক চান্সেই মাধ্যমিকের গন্ডি পার হয়ে গেল। পায়ে চামচ নিয়ে স্কুলে মিডডে মিল খাওয়া জগন্নাথ ।
বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের কথায়,ভালো ফুটবলও খেলার পাশাপাশি জগন্নাথ পায়ে করে খুব ভালো ছবিও আঁকে।তাঁর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে স্কুলে ক্লাস করা ও লেখা লেখির জন্য স্কুলের তরফে বিশেষ বেঞ্চের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় ।স্কুলে সহপাঠীরা সবসময় জগন্নাথের পাশে থাকতো।বেশিরভাগ দিন সহপাঠীরা তাঁদের সাইকেলে জগন্নথকে চাপিয়ে নিয়ে স্কুলে আসতো। প্রধান শিক্ষক এও জানান,পায়ে করে লিখে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য জগন্নাথ যাতে অতিরিক্ত সময় পায় তারজন্য পর্শদে আবেদন আনানো হয়। পর্শদ তা অনুমোদনও করে’। সিমলা গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ সাঁতরা বলেন,“জগন্নাথ আমাদের গ্রামের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে প্রেরণা। তাই পরীক্ষার কটা দিন আমি ওকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসার দায়িত্ব নিয়েছিলাম ।
জগন্নাথ যে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল সেই বাগিলা পূর্ণচন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা অনন্যা তরফদার খুশি হয়েছেন জগন্নাদ পাস করেছে জেনে ।তিনি এদিন বলেন,’পা দিয়ে জগন্নাথ এত সুন্দর করে পরীক্ষার খাতায় লিখছে, যা স্বঃচোক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা দায় ।পায় দিয়ে লেখাও যে এত সুন্দর হয় এবং কেউ পা দিয়ে উত্তর পত্রে গুছিয়ে লিখতে পারে সেটা জগন্নাথকে দেখেই আমরা জানতে পারি। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এই ছাত্র যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে,সেটা সত্যি গর্বের বলে অনন্যা তরফদার মন্তব্য করেছেন ।
জগন্নাথ এদিন জানায়,’প্রতিদিন যখনই সময় পেতাম পড়তে বসতাম ।অন্য ছাত্রদের মত একাধীক সাবজেক্টে প্রাইভেট টিউটর নেওয়ার সামর্থ আমার ছিল না। মাত্র একজন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যবার সৌভাগ্য কোনরকমে হয়েছিল ।স্কুলের শিক্ষকরাই তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন ।’ কষ্ট যাই হোক,আগামী দিনেও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় জগন্নাথ জানিয়েছে । জগন্নাথের ঠাকুমা মুঙ্গলী মাণ্ডি ও পিস রিবি মুর্মু বলেন,’জগন্নাথ লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত হোক, মানুষের মত মানুষ হোক এটাই আমরা চাই ।’।