প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২১ এপ্রিল : হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে রেফার রোগী মেনকা কোঁরার মৃত্যুর ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু করলো স্বাস্থ্য দপ্তর। পূর্ব বর্ধমান জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ)জয়রাম হেমব্রম শুক্রবার ভাতার স্টেট জেনারেল হাসপাতালে বিভাগীয় তদন্তে যান । তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি সিএমওএইচ ২ সূবর্ণ গোস্বামী। তদন্তে গিয়ে তারা দীর্ঘক্ষণ ভাতার ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক সংঘমিত্রা ভৌমিক ও অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে সবিস্তার ঘটনা জানতে চান।জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিককে সামনে পেয়ে স্থানীয়রা এদিন ভাতার হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে একরাশ ক্ষোভ জানান। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মনযোগ দিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের কথা শুনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
বর্ধমান শহরের পারবীরহাটা এলাকার বাসিন্দা মেনকা কোঁরা(৫০) ও তাঁর স্বামী অসিত কোঁরা পেশায় খেত মজুর। বোরো ধান গাছ কাটার কাজ করার জন্য দিনচারের আগে ভাতারের কাঁচগড়িয়া গ্রামে এসেছিলেন এই দম্পতি। প্রচণ্ড উত্তাপের মধ্যে দু’তিন দিন খেতের জমিতে কাজ করে মেনকাদেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার সকালে মেনকাদেবীকে ভাতার স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁর স্বামী।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা করে তাকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে দেন। ওইসময় অসুস্থ স্ত্রীকে বর্ধমান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ করেন। অভিযোগ,অ্যাম্বুলেন্স নেই বলে হাসপাতাল থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি গাড়ি ভাড়া করে রোগীকে বর্ধমান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।পকেটে টাকা পয়সা তেমন না থাকায় সরকারী অ্যান্বুলেন্সের জন্য অসিতবাবু অনেক আবেদন নিবেদন করলেও তাতে কারোর মন গলে না। বাধ্য হয়ে বর্ধমান যাবার জন্য অসুস্থ স্ত্রীকে টোটোয় চাপিয়ে নিয়ে অসিত বাবু ভাতার স্টেশনে পৌছান। স্টেশনে একটি গাছের নিচে চাতালে স্ত্রীকে বসিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন অসিতবাবু। ওখানেই মৃত্যু হয় মেনকাদেবীর । এই ঘটনা সামনে আসার পরেই সরকারি ভাতার হাসপাতালের চিকিৎসকদের অমানবিকতা ও পরিষেবা মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন স্থানীয়রা । এক দরিদ্র পরিবারের বধূর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর রাজ্যের প্রশাসনিক মহলও নড়েচড়ে বসে ।
রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশে শুক্রবার দুপুরে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ও ডেপুটি সিএমওএইচ ভাতার হাসপাতালে যান। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা (ডিএইচএস) সিদ্ধার্থ নিয়োগী এদিন জানান,’ঘটনার কথা শুনেছি। সিএমওএইচ তদন্তে গিয়েছেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ আর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জয়রাম হেমব্রম বলেন,:আমি ঘটনা বিষয়ে খোঁজখবর নিলাম। ওই মহিলার শরীর ভীষণ দুর্বল ছিল বলে জানতে পারলাম।ওনার ব্লাডসুগারও নেমে গিয়েছিল। তার জন্য যথাযথ চিকিৎসা করে তাকে বর্ধমানে রেফার করা হয়েছিল। কিন্তু রোগীর পরিবারের লোকজন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সেভাবে কিছু বলেননি । তবে আমরা চেষ্টা করবো যাতে এই ধরনের ঘটনার পুনুরাবৃত্তি না হয় ।’
স্ত্রীর মৃতদেহ আগলে স্বামী ।
এদিন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ভাতার হাসপাতালে আসার পরেই স্থানীয় বাসিন্দারা ভাতার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তথা বিএমওএইচ সংঘমিত্রা ভৌমিকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে সোচ্চার হন। ভাতার গ্রামপঞ্চায়েতের স্থানীয় সদস্য পার্থসারথী মণ্ডল বলেন,’সরকারি অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে তখন দাঁড়িয়ে থাকতেও ওই গরিব মানুষটি সময়ে চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন। ভাতার হাসপাতালে বিএমওএইচ এবং অন্যান্য কর্মীরা মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে নিজেরা চেপে ঘুরে বেড়ান। অথচ গরিব মানুষ প্রয়োজনের সময় পান না।’
জানা যায়,অসিত কোঁরা যখন তার স্ত্রীকে কিভাবে বর্ধমানে নিয়ে যাবেন চিন্তা করছিলেন তখন ভাতার হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্স জরুরি বিভাগের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। যদিও ওই সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালক কৈলাস রায় বলেন,আমি বিষয়টি জানতাম না। আমাকে হাসপাতাল থেকে কোনও রোগীকে বর্ধমানে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়নি। কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিলে অবশ্যই নিয়ে যেতাম। তবে বর্ধমানে যেতে কোনও ভাড়া না লাঘলেও ৭ লিটার ডিজেল দিতে হয়। যদি বিএমওএইচ নির্দেশ দেন ডিজেলের মূল্য ছাড়াই নিয়ে যেতে তখন তার কথামতো নিয়ে যাই ।
এদিন স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা সিএমওএইচ এর কাছে নালিশ করেন হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরেই দালালচক্র কাজ করছে। তাকে সাধারণ মানুষের পরিষেবা পেতে সমস্যা হচ্ছে। সিএমওএইচ সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন।।