এইদিন ওয়েবডেস্ক,ঢাকা,১০ এপ্রিল : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মহিলাদের উপর কি নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছিল তা আজও মানুষের অজানা । বন্য পশুদের নৃশংসতাকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল পাকিস্থানি নরপশুর দল । শুধু হিন্দুই নয়,হাজার হাজার মুসলিম মহিলাও দিনের পর দিন ধরে পাকিস্থানি সেনাদের দ্বারা গনধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন । বাংলাদেশের এমন অনেক মহিলা জীবিত আছেন যারা আজও তাঁদের মনের মধ্যে পাকিস্থানি সেনার সেই পাশবিক অত্যাচারের ভয়াবহ স্মৃতি বহন করে যাচ্ছেন । এতদিন সেই নৃশংসতার কাহিনী পরিকল্পিতভাবে জনসমক্ষের আড়ালে রেখে দেওয়া হলেও সাম্প্রতিক সময়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন গনধর্ষিতা মহিলারা ।
৬৫ বছর বয়সী বাংলাদেশের রাজশাহীর বাসিন্দা নূর জাহান ওই সমস্ত মহিলাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি মিডিয়ার কাছে বলেছেন,’সময়টা ছিল একাত্তর সালের গ্রীষ্মকাল। আমি তখন ১৪ বছরের কিশোরী । ছোট বোনের সাথে আমি বাড়ির বাইরে খেলা করছিলাম । সেই সময় পাকিস্তানের একটি সামরিক ট্রাক বিকট শব্দে আমাদের খামারবাড়ির বাইরে এসে থামে । কিছু বুঝে ওঠার আগেই সশস্ত্র সৈন্যরা আমাদের দু’বোনকে ট্রাকের পেছনে তুলে নেয় । ট্রাকে উঠে দেখি বেশ কয়েকজন মহিলা হাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় বসে আছেন । তারা আমাদের নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে এবং চুপ থাকতে বলেছিলেন । ট্রাকটি ছোট শহরের মধ্য দিয়ে কয়েক জায়গায় থেমে থেমে ফের চলতে থাকে । প্রতিবারই আরো নারী ও মেয়েদের বোঝাই করে, যেন তারা গবাদি পশু । সবাই নীরবে কান্নাকাটি করছিলো । তারা শব্দ করতেও ভয় পাচ্ছিলো।’
নূর জাহান বলেন,’আমাদের কোন ধারণা ছিল না তারা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আমি আমাদের বাড়ির চারপাশের গাঁদা ক্ষেতগুলোকে দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে দেখছিলাম । আমার মনে আছে আমি আমার বোনের হাত শক্ত করে ধরে ছিলাম এবং পুরোটা সময় চরম ভয়ের মধ্যে কাটিয়েছিলা । তার আগে আমরা সবাই বাংলার কসাই ও তার লোকদের কথা শুনেছিলাম ।’
প্রসঙ্গত,নৃশংসতার সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করা পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার জেনারেল টিক্কা খানকে তখন বাংলার কসাই বলে চিনতো বাংলাদেশের মানুষ । ওই নরপশু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি স্বাধীনতাকামীদের উপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বরোচিত এক অভিযান শুরু করেছিল । সেই অভিযানের আড়ালে চলে ব্যাপক হারে গনধর্ষণ ও নরসংহার ।
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, টিক্কা খানের উদ্দেশ্য ছিল সর্বাধিক সংখ্যক বাংলাদেশী মহিলাকে গর্ভবতী করা । নিজেদের প্রজন্মের জন্ম দিয়ে বাংলাদেশে চিরস্থায়ী রাজত্ব করার লক্ষ্য ছিল ওই বর্বর পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডারের । তাতে সে আংশিক সফলও হয়েছে । কারন আজ বাংলাদেশের মৌলবাদীদের একটা বড় অংশই পাকিস্থানি সেনাদের ঔরসজাত সন্তান বলে মনে করা হয় । যে কারনে তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় নৃশংসতা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সমর্থনে গলা ফাটায় ।
নূর জাহান বলেন,’অবশেষে ট্রাক থামার পর আমাদের সকলকে সামরিক ব্যারাকের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় । বন্দি অবস্থায় আমি প্রায়ই অচেতন হয়ে পড়তাম । আমরা সেখানে মরার মতো পাশাপাশি পড়ে থাকতাম । একটি রুমে সম্ভবত আমরা ২০ থেকে ৩০ জন ছিলাম । কেবল একটা সময়ই আমরা দিনের আলো দেখতাম, যখন দরজা একটু ফাঁক হয়ে যেত আর সৈন্যরা ভেতরে ঢুকত। আর তারপর শুরু হতো গনধর্ষণ।’
৭৮ বর্ষীয়া রাজিয়া বেগম বলেন,’তখন ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস । আমার স্বামী আবু সরকারকে কয়েকদিন ধরেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না । তিনি ঢাকার তেজতুরি বাজার এলাকার রাস্তায় ফল বিক্রি করতেন । আমি তাকে খুঁজতে বের হয়েছিলাম । রাস্তার একটা মোড়ে আসতেই একদল সৈন্য আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় । একজন আমার মাথায় রাইফেল দিয়ে আঘাত করলে আমি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি । তারপর তারা আমায় জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ তারা আমাকে গনধর্ষণ করে । একজন পথচারী অবশেষে আমাকে খুঁজে পেয়ে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান ।’
রাজিয়া বলেন,’সেই সময়ে মহিলারা প্রায়ই বাড়ি থেকে বের হতেন না, তাই আমরা অনেকেই আমাদের সঠিক ঠিকানাও জানতাম না । আমার স্বামী আমাকে খুঁজে বের করার আগে চারটি ভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে চেষ্টা করেছিলেন ।’ তিনি বলেন,’যা হয়েছে তা নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু এত বছর পরেও আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন। আমি এখনও দুঃস্বপ্ন দেখি ।’
যুদ্ধের পর পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় সাহায্য করার জন্য মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের একত্রিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ গার্ল গাইড অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সেক্রেটারি মালেকা খানকে। তবে ঢাকার জাহাঙ্গীর গেটের কাছে আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে ধর্ষিত ও বন্দী নারীদের খোঁজ পাওয়ার কথা জানার পর, খান উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে গিয়ে খান যা দেখেছিলেন তাতে তিনি হতবাক হয়ে যান। ৮০ বছর বয়সী মালেকা খান বলেন, সেখানে নারীরা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় ছিল। যুদ্ধের সময় বাঙ্কারে রেখে তাদেরকে নির্যাতন করা হয় ও সেখানেই ফেলে যাওয়া হয়। তিনি তাদেরকে জামাকাপড় কিনে দেন এবং তাদের সাহায্য করার পর সযত্নে শাড়ি ও কম্বলে মুড়িয়ে দেন । তিনি বলেন,’তারা হতবাক হয়ে গিয়েছিল এবং কথা বলতে পারছিলো না । কারও কারও চুল কাটা ছিল, অন্যরা গর্ভবতী ছিল । পুরো বিষয়টি নিয়ে অবিশ্বাসের হাওয়া বইছিল। সম্পূর্ণ ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ।’
বাংলাদেশের মহিলাদের গনধর্ষণের জন্য সারাদেশে সামরিক ধাঁচের ধর্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়েছিলো । সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী,ওই সময় ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা ২ লাখ থেকে ৪ লাখের মধ্যে ছিল । এদিকে ধর্ষিতা হওয়ার পরে ওই বিপূল সংখ্যক মহিলাদের সমাজ থেকে একঘরে করা হয়েছিলো । তারপরে তাদের কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতে হয় । অনেকের অকালেই মৃত্যু হয় । কিন্তু আজও বহু গনধর্ষিতা মহিলা জনসমক্ষের আড়ালে থেকে সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি বহন করে যাচ্ছেন ।।