প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৮ মার্চ : শ্রমিকের কাজ করতে ব্যাঙ্গালুরু গিয়ে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে সেখানকার জলে বন্দি রয়েছে ছেলে ও বৌমা। রেহাই পায়নি তাঁদের দেড়বছর বয়সী শিশুপুত্রও । ছেলে,বৌমা ও নাতিকে ব্যাঙ্গালুরুর জেল থেকে মুক্ত করে পশ্চিমবঙ্গের বাড়িত ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ৮ মাস ধরে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বাবা পঙ্কজ অধিকারী।আইনি লড়াই চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এই অসহায় পিতা আর মানসিক চাপ নিতে না পেরে ব্যাঙ্গালুরুতেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছেলে,বৌমা ও প্রিয় নাতিকে ব্যাঙ্গালুরুর জেলে ফেলে রেখেই পঙ্কজ বাবু মঙ্গলবার বাংলায় নিজের বাড়িতে ফিরলেন ঠিকই।তবে নিথর দেহ হয়েই তিনি ফিরলেন।দুই মেয়ে সাথী ও শম্পা এদিন স্তানীয় শ্মশানে তাঁদের বাবা পঙ্কজবাবুর অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করেন । সন্তান- সন্ততিদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় এক পিতার এমন মৃত্যু শোকাতুয় করে তুলেছে পঙ্কজবাবুর পরিজন ও প্রতিবেশীদের ।
ব্যাঙ্গালুরুর জেলে বন্দি থাকা দম্পতি পলাশ অধিকারী ও শুক্লা অধিকারী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের
পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার জৌগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার তেলে গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা।সেখানে রয়েছে তাঁদের টিনের চালার দু’কুঠুরি ভাঙাচোরা বাড়ি। ওই বাড়ি দেখলে যে কেউ বুঝে যাবেন দারিদ্রতাই অধিকারী পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী।পলাশদের মতোই তাদের প্রতিবেশীরাও অত্যন্ত দরিদ্র।মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুই শুধুমাত্র তাদের সম্বল। তাদের বেশিরভাগ জনই দিন মজুরির কাজ করে অন্নের সংস্থান করেন। বাকিদের কেউ বালাপোশ তৈরি, আবার কেউ বিড়ি বাঁধার কাজ করে উপার্জন করেন।এমনই এক গ্রামের ছেলে পলাশ রোজগারের আশায় স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গত বছরের জুন মাসে গিয়েছিলে ব্যাঙ্গালুরু ।কিন্তু উপার্জন করা তো দূরের কথা ,উল্টে সেখানে তাঁদের পরিণতি হয় ভয়ংকর।
তেলে গ্রামেই বসবাস করেন পলাশ অধিকারীর আত্মীয় পিন্টু হাওলাদার । তিনি জানান,শ্রমিকের কাজ করার জন্য শিশু পত্রকে সঙ্গে নিয়েই পলাশ তাঁর স্ত্রী ব্যাঙ্গালুরু যায় । একই উদ্দেশ্যে পালাশের বাবা পঙ্কজ অধিকারী, মা সবিতাদেবী ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারীও ব্যাঙ্গালুরু যান।সেখানকার মারাথাহাল্লি (Marathahalli) মহকুমার ভারথুর (varthur) থানার সুলিবেলে(sulibela) গ্রামের কায়েন খাঁনের ডেরায় তারা ওঠে।সেখানে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরির শর্তে তারা কায়েন খাঁনের অধীনে কাজ করা শুরু করেন।তাদের কাজ ছিল হোটেল,রেঁস্তোরা,সিনেমা হল সহ বিভিন্ন জয়গা থেকে সংগৃহীত বর্জ্যবস্তু,বোতল,প্লাস্টিক সরঞ্জাম এইসব বাছাই করা ।
পিন্টু হাওলাদার বলেন,পলাশরা ব্যাঙ্গালুরু যাবার পর প্রথম দিকে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল । হঠাৎ করেই ওই বছরের ২৭ জুলাই ভারথুর (varthur) থানার পুলিশ কায়েন খাঁনের ডেরায় হানা দেয়
। সেখানে যাঁরা যাঁরা বাংলাভাষী ছিল তারা সবাই নাকি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী,,এমন সন্দেহে ভারথুর থানার পুলিশ পলাশদের ও আরো পাঁচ জনকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যায়। ওইসময়ে পলাশ,তাঁর স্ত্রী,বাবা-মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী সবাই ভারথুর থানার পুলিশকে জানান তাঁরা কেউই বাংলাদেশী নন । তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে জানিয়ে নিজের নিজের আধার কার্ড,প্যান কার্ড,ভোটার কার্ড দেখান। সেইসব দেখে সেখানকার পুলিশ পলাশের বৃদ্ধ বাবা,মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারীকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র ছাড়ে না । ভারথুর থানার পুলিশ বাংলাদেশী অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেয় । সেই থেকে প্রায় আট মাস হয়েগেল শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে পলাশ ও তাঁর স্ত্রী ব্যাঙ্গালুরুর জেলে চোখের জল ফেলেই দিন কাটাচ্ছে বলে পিন্টু হাওলাদার জানিয়েছেন ।
প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী বলেন, আমিও রোজগারের আশায় পলাশদের সঙ্গেই ব্যাঙ্গালুরু যাই । সেখানে ভারথুর থানার পুলিশ আমাকেও বাংলাদেশী অনুপ্রেবশকারী সন্দেহে ধরে । ওখানকার পুলিশের সঙ্গে আমাদের কথা বলার ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা হচ্ছিল । ওরা আমাদের কথা যেমন বুঝতে পারছিল না,তেমন আমরাও ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবুও আমি, পলাশের বাবা- মা ও পলাশ বাংলা ভাষাতেই ভারথুর থানার পুলিশকে বারেবারে বলে যাই আমরা ভারতীয়, পশ্চিমবাংলার বর্ধমানের বাসিন্দা । তেলে গ্রামে থাকা আমার স্ত্রীর ফোন নম্বার ওরা চাইলে সেটাও আমি দিয়েদি। এরপর ওরা কি বুঝলো জানিনা ! আমাকে এবং পালাশের বাবা ও মাকে ছেড়ে দেয় ।কিন্তু অদ্ভুতভাবে পলাশ এবং তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে ছাড়ে না। তদের জেলে পাঠিয়ে দেয় । বাবা ও মা ভারতীয় বলে ব্যাঙ্গালুরু পুলিশের কাছে গন্য হল, অথচ ওই বাবা মায়ের ছেলে,বৌমা ও নাতি কিভাবে বাংলাদেশী হয়ে গেল সেটা আজ অবধি বুঝে উঠতে পারেননি বলে সুনীল অধিকারী মন্তব্য করেছেন ।
হুগলীর বৈচিগ্রাম নিবাসী পলাশের ভগ্নিপতি সুজন হালদার বলেন,পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের এমন করুণ পরিণতির কথা জেনে তিনি ব্যাঙ্গালুরু পৌছান। কিন্তু কোন ভাবেই কিছু সুরাহা করতে পারেন না । যে আইনজীবীকে নিযুক্ত করেছেন তার কাছ থেকেও আশানুরুপ সহযোগীতা পাচ্ছেন না ।তেলে গ্রাম নিবাসী জৌগ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য কৃষ্ণা সরকার বলেন,পলাশ ও তাঁর পরিবারের সবাই তেলে গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা । এখানকার ভোটার । তার পরেও ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ কোন যুক্তিতে পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে গ্রেপ্তার করলো সেটাই কারুর বোধগম্যে হচ্ছে না বলে পঞ্চায়েত সদস্য মন্তব্য করেছেন ।
জৌগ্রামের কলুপুকুর নিবাসী পলাশের ছোট বেলার বন্ধু দেবরাজ সেন বলেন, স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে নিয়ে পলাশের ব্যাঙ্গালুরুর জেলে বন্দি থাকার খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর গত বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ ব্যাঙ্গালুরু পুলিশের একটি দল তেলে গ্রামে পলাশদের বাড়িতে আসে। বেঙ্গালুরু পুলিশ প্রথম থেকেই সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করে । পলাশদের বাড়ির জমির দলিল,পলাশ ও তাঁর স্ত্রীর ভোটার কার্ড, আধার কার্ড,ব্যাঙ্কের একাউন্ট বই সহ সবকিছু বেঙ্গালুরু পুলিশকে দেখানো হয় । কিন্তু বেঙ্গালুরু পুলিশ সেই সবকে ভারতীয় নাগরিকত্ত্বের প্রমান বলে মানতে চায় না। দেবরাজ বলেন,এর কারণ জানতে চাইলে বেঙ্গালুরু পুলিশের কাছ থেকে জবাব মেলে ২ টাকা খরচ করলেই নাকি এই দেশের ভোটার কার্ড,আধার কার্ড ও প্যান কার্ড পাওয়া যায়। বেঙ্গালুরু পুলিশ পলাশের ঠাকুরদার আমলের জমির দলিল দেখাতে বলে। দেবরাজ বলেন,এর পরিপ্রেক্ষিতে তেলে গ্রামের সবাই মনে করছেন, এনআরসি-র (NRC) জাঁতাকলে ফেলেই হয়তো বেঙ্গালুরু পুলিশ পলাশদের জেলবন্দি করে রাখার পন্থা নিয়েছে ।
বিডিও( জামালপুর ) শুভঙ্কর মজুমদার বলেন,
ভারথুর থানার পুলিশের তিন জন আধিকারিক আমার দফতরে আসে। পলাশ অধিকারী ও তাঁর স্ত্রী প্রকৃতই ভারতীয় নাগরিক কিনা এবং তাদের ভোটার ও আধার কার্ডটি সঠিক কিনা সেইসব বিষয়ে বেঙ্গালুরু পুলিশ আমার কাছে জানতে চায় ।এছাড়াও পলাশদের পারিবারিক পরিচিতি, কতদিন তারা তেলে গ্রামে বসবাস করছে,তাদের কাস্ট স্ট্যটাস সহ নানা বিষয়ে তারা জানতে চায় ।এইসব বিষয়ের তথ্যও তারা যাচাই করে। দম্পতির ভারতীয় নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত সব তথ্য ভারথুর থানার মেইল আইডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । বিডিও এও জানান, ভারথুর থানার তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকরা শুধু জামালপুরের বিডিও অফিস ও থানায় তথ্য যাচাই করে ফিরে যান, এমনটা নয়। বেশ কয়েকদিন ধরে ওই পুলিশ আধিকারিক দল জামালপুরের দলিল রেজিস্ট্রি অফিস,ভূমি দফতরের অফিস, জৌগ্রাম পঞ্চায়েত এমনকি বর্ধমান দক্ষিন মহকুমা শাসকের অফিসে গিয়েও ওই দম্পতির নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য যাচাই করে নিয়ে গেছে । এত কিছুর পরেও পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র বেঙ্গালুরুর জেল থেকে কেন মুক্তি পাচ্ছেন না সেটাই আশ্চর্য্যের বল বিডিও মন্তব্য করেছেন ।।