এইদিন ওয়েবডেস্ক,২৪ মার্চ : বাবা ভাঙ্গা(Baba Vanga) বা ভ্যাঙ্গেলিয়া পান্ডেভা সুরচেভা (Vangeliya Pandeva Surcheva) ছিলেন একজন অন্ধ বুলগেরিয়ান মেয়ে,যিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন । তাঁকে তথাকথিত “বলকানদের নস্ট্রাডামাস”ও বলা হত । কিন্তু তার শৈশব এবং যৌবনকালে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল । তবে তিনি সেই সমস্ত প্রতিকুলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন । অলৌকিক ক্ষমতা বলে দেশ ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তার নাম ।
কিন্তু কেমন ছিল তাঁর জীবন ? আসুন জেনে নেওয়া যাক ভ্যাঙ্গেলিয়ার বাবা ভাঙ্গা হয়ে ওঠার কাহিনী :-
বুলগেরিয়ার স্ট্রুমিকায় ১৯১১ সালের ৩ অক্টোবর পরস্কেভা সুরচেভা(Paraskeva Surcheva) এবং পান্ডো সুরচেভের(Pando Surchev) ঘরে জন্ম হয়েছিল তার । জন্ম থেকেই অনেক স্বাস্থ্য জটিলতা থাকায় প্রথমে তার নাম দেওয়া হয়নি । এটি বুলগেরিয়ান লোক প্রথার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল যা অনুসারে একটি শিশুর মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তার নাম রাখা হত না । যখন শিশুটির দুই মাস বয়স হল,ক্রমশ স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে শুরু করে । তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দেখে একজন অপরিচিত পথিক তার নাম দেন ভ্যাঞ্জেলিয়া। এটি ছিল আরেকটি নামকরণের প্রথা যা শিশুর নামকরণের দিনে শিশুটির ঠাকুমা রাস্তায় বেরিয়ে যেতেন এবং প্রথম অপরিচিত ব্যক্তিকে নাম জিজ্ঞাসা করতেন ।
ভ্যাঞ্জেলিয়ার শৈশব চ্যালেঞ্জিং ছিল । মাত্র তিন বছর বয়সে তার মা মারা যান। বাবা একজন অভ্যন্তরীণ ম্যাসেডোনিয়ান বিপ্লবী সংগঠনের কর্মী ছিলেন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাকে জোর করে বুলগেরিয়ান সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল । এই কারণে বাবা ভাঙ্গাকে তার প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হত ।
ভ্যাঞ্জেলিয়ার বয়স যখন সাত, তার বাবা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেন । স্ট্রুমিকাকে এখন যুগোস্লাভিয়া অন্তভূক্ত হলেও তখন সার্ব, ক্রোট এবং স্লোভেনিস রাজ্যের মধ্যে পড়ত ।
এদিকে ভ্যাঞ্জেলিয়ার বাবা একজন বুলগেরিয়ানপন্থী কর্মী হওয়ায় তার সমস্ত সম্পদ এবং সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল । এই কারনে বহু বছর ধরে দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল বাবা-মেয়ের জুটিকে । তবে শৈশব থেকেই ভ্যাঞ্জেলিয়া বুদ্ধিমতি ছিলেন । অনেক অল্প বয়স থেকেই ভেষজ উদ্ভিদ সম্পর্কে জ্ঞান রপ্ত করে ফেলেছিলেন তিনি । নিজের পরিবারের পাশাপাশি প্রতিবেশীদেরও বিভিন্ন রোগে গাছগাছরার ওষুধ দিতেন । ইতিমধ্যে ভ্যাঞ্জেলিয়ার বাবা পুনরায় বিয়ে করেন । ফলে তাদের তাদের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে । তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি । তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়নি । বরঞ্চ আর্থিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে । শেষে ভ্যাঞ্জেলিয়া বাবা তাদের নিজ শহর মেসিডোনিয়ায় (Macedonia) ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে তারা নভো সেলো (Novo Selo) নামে একটি নতুন শহরে বসবাস শুরু করেন ।
কিন্তু নভো সেলোতে ১৯২৪ সালে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা চিরকালের জন্য ভাঙ্গালিয়ার জীবনকে বদলে দেয় । সেই দুর্ঘটনায় তার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয় । সেই বিষাদময় দিনে কী ঘটেছিল তা নিয়ে অনেক গল্প আছে। কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে যে ভ্যাঙ্গেলিয়া তার খুড়তুতো ভাইদের সাথে মাঠে খেলছিল যখন একটি ঝড় আঘাত হানে । ঝড় শান্ত হওয়ার পরে, ভাঙ্গালিয়া ছাড়া বাকি সব শিশুকে খুঁজে পাওয়া যায় । পরের দিন সকালে তাকে আবর্জনার স্তুপের মধ্যে গুরুতর জখম অবস্থায় উদ্ধার করে পরিবারের লোকজন । তার চোখ মারাত্মকভাবে আঘাত পায় । দু’চোখে বালিতে বুজে গিয়েছিল,ফলে সে চোখ খুলতে পারেনি । কী ঘটেছে তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, মেয়েটির উত্তর শুনে অনেকের মনে করে সে একটি মনগড়া গল্প বলছে । ভাঙ্গার কথামতো ঘূর্ণিঝড়ে তাকে ছাড়া সবাইকে ছিটকে দিয়েছিল এবং ঝড় তাকে তুলে নিয়ে যায় । তাকে কয়েকশ মিটার নিয়ে গিয়ে মাঠে ফেলে দেয়। এই জীবন-পরিবর্তনকারী ঘটনায়, ভাঙ্গা দাবি করেছিলেন তিনি চেতনা হারানোর আগে কেউ তাকে স্পর্শ করেছিল । এদিকে যারা তাকে সেদিন উদ্ধার করেছিল তাদের কথায় মেয়েটি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। তার চোখ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল। ভাঙ্গার ক্ষতগুলি গুরুতর ছিল এবং অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল । তার চোখের চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং বিশেষ ওষুধের প্রয়োজন ছিল । কিন্তু পরিবারের আর্থিক অসুবিধার কারনে ভাঙ্গার শুধুমাত্র একটি আংশিক অপারেশন করাতে পারে । ফলে তার আঘাতগুলি নিরাময় হলেও আর দৃষ্টি শক্তি ফেরেনি ।
পরে কয়েক বছর তার পরিবারের সাথে কাটানোর পর ১৯২৫ সালে ভাঙ্গাকে জিউম (Zeum)নামে একটি শহরে পাঠানো হয় । যেখানে তিনি পরবর্তী তিন বছর অন্ধদের জন্য একটি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন । তবে তার স্কুল জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। কিন্তু জানা যায় যে তাকে রান্না করা, পরিষ্কার করা এবং বুননের মতো প্রাথমিক গৃহকর্ম শেখানো হয়েছিল । তাকে পিয়ানো বাজাতে এবং ব্রেইল পড়তেও শেখানো হয়েছিল । তার সৎ মায়ের অকাল মৃত্যু না হলে তিনি হয়তো আরও কয়েক বছর এখানে কাটিয়ে দিতেন । কিন্তু সৎ মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা বাড়ির দায়িত্ব নিতে এবং তার ছোট ভাইবোনদের যত্ন নেওয়ার জন্য মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসেন ।
এদিকে বাবা ভাঙ্গা তার গ্রামে ফিরে পুরানো বন্ধুদের সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করেছিল। এবং রান্না করা, পরিষ্কার করা এবং অন্যান্য গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি ভাঙ্গা তার বন্ধুদের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে শুরু করেন । প্রথমে এটি রসিকতা হিসাবে শুরু হয়েছিল । কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি প্রমাণিত হতে শুরু করলে ভাঙ্গা তার “সত্যিকারের ক্ষমতা” উপলব্ধি করেন । তিনি ইতিমধ্যেই স্বপ্নে অস্বাভাবিক কিছু জিনিস অনুভব করতে শুরু করেন । তিনি কণ্ঠস্বর শুনতে, জিনিস দেখতে, এমনকি মৃত এবং গাছপালা সঙ্গে কথা বলতে পারতেন । পরে তিনি এমন ঘটনাগুলির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যা পরবর্তী কালে সত্যি প্রমাণিত হয় । এরপর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ।
যাইহোক, ১৯৩৯ সালে একটি নতুন ট্র্যাজেডি মেয়েটিকে আঘাত করেছিল । এবার ফুসফুসের রোগ ‘প্লুরিসি’তে আক্রান্ত হন তিনি । এই সময় ডাক্তাররা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ভাঙ্গার মৃত্যু আসন্ন । কিন্তু চিকিৎসকদের অনুমান মিথ্যা প্রমাণিত হয় । সেই সময়কালের আরও একটি গল্প রয়েছে । ভাঙ্গা দাবি করেছিলেন, একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে একজন ব্যক্তি তার কাছে এসেছিল । তখন ভাঙ্গার বয়স ৩০ বছর । ওই ব্যক্তি ভাঙ্গাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে অনেক দুর্দান্ত কাজ করবেন । তিনি তাকে বলেছিলেন যে তিনি মানুষের মৃত্যু এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলবেন এবং তার ভয় পাওয়ার দরকার নেই কারণ তিনি তাকে গাইড করবেন এবং তাকে সঠিক কথা জোগাবেন । আর ১৯৪১ সালের এই ঘটনার পর ভাঙ্গার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তিন শুরু হয় । প্রথমে তিনি গ্রামের কৃষকদের হারিয়ে যাওয়া গবাদি পশু খুঁজে পেতে সাহায্য করতেন । ভাঙ্গার বলে দেওয়া জায়গা থেকেই পাওয়া যেত হারিয়ে যাওয়া পশুগুলি । এছাড়া যুদ্ধে যাওয়া এলাকার পুরুষ সদস্যদের বিষয়েও ভাঙ্গার কথা হুবহু মিলে যেত । পাশাপাশি গ্রামবাসীদের বিভিন্ন রোগের ভেষজ ওষুধ দিয়ে রোগ নিরাময় করতেন বাবা ভাঙ্গা । ফলে প্রতিদিন কাতারে কাতারে মানুষ তার কাছে ছুটে আসত ।
এদিকে বুলগেরিয়ার জার বরিস তৃতীয় ভাঙ্গার অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে জানতে পেরে তার কাছে ছুটে আসেন । তখন ১৯৪২ সাল । শোনা যায়,ভাঙ্গা বরিস তৃতীয়ের সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন । এর পরে তার খ্যাতি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে ।
১৯৪২ সালে একজন বুলগেরিয়ান সৈনিক দিমিতার গুশতেরভকে বিয়ে করেছিলেন বাবা ভাঙ্গা । তারপর প্যাট্রিচের কাছে একটি গ্রামে চলে যান । তবে তার বৈবাহিক জীবন সুখের হয়নি । কারন ভাঙ্গার স্বামীকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং তাকে চলে যেতে হয়েছিল । গুশতেরভ মদ্যপ ছিলেন । অতিরিক্ত মদ্যপানের জেরে ১৯৬২ সালে তার মৃত্যু হয় । ভাঙ্গা ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ ভবিষ্যদ্বাণী করেন । কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১১ আগস্ট তার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে । আর তার অল্প দিনের মধ্যে ৮৫ বছর বয়সে বাবা ভাঙ্গার মৃত্যু হয় । বিশ্বের বহু মানুষ তার শবযাত্রায় অংশ নিয়েছিল ।।