জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গুসকরা(পূর্ব বর্ধমান),১৪ মার্চ : ২০১৩ সালে নির্বাচিত তৃণমূল পরিচালিত পূর্ব বর্ধমান জেলার গুসকরা পুরসভার মেয়াদ ২০১৮ সালে শেষ হয় । তারপর পুরসভা পরিচালনা করার জন্য প্রথমে প্রশাসক ও পরে প্রশাসকমণ্ডলী নিয়োগ করা হয়। সদস্যরা ছিল তৃণমূলের নেতা-নেত্রী। অবশেষে ২০২২ সালের শুরুতে রাজ্যের শতাধিক পুরসভার সঙ্গে গুসকরা পুরসভাতেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ ছিল সেই নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও শেষ পর্যন্ত গুসকরা শহরের সবকটি আসনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়লাভ করে।
নানাদিক দিয়ে তৃণমূলের কাছে গুসকরা পুরসভার নির্বাচন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিগত পুরসভার বেশ কিছু দুর্নীতি ছিল সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয়। এবার সবকটি আসনেই প্রার্থী হিসাবে ছিল নতুন মুখ। প্রথমে শহর সভাপতি ও পরে প্রশাসক মণ্ডলীর সদস্য হিসাবে বর্তমান চেয়ারম্যান কুশল মুখার্জ্জী ছাড়া অন্যদের সেভাবে রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা ছিলনা। যদিও যেকোনো শুরুটা শূন্য থেকেই শুরু হয়।
প্রার্থী তালিকা নিয়েও ছিল কিছু অশান্তি । রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব বিধায়কদের পুরসভার প্রার্থী হিসাবে নাম আগেই বাতিল করে দেয়। ফলে প্রথমেই সম্ভাব্য বিতর্ক প্রথমেই দূর হয়। রাজ্যের তালিকায় তিন নম্বর ওয়ার্ডে ডাকাবুকো নেত্রী মল্লিকা চোংদারের নাম থাকলেও এলাকার দায়িত্ব প্রাপ্ত অনুব্রত মণ্ডল তার নাম তালিকা থেকে বাদ দেন । সেটা নিয়েও একদফা বিতর্ক ইত্যাদি।
যাইহোক শেষপর্যন্ত সব বিতর্ককে দূরে সরিয়ে রেখে ২০২২ সালের ১৬ ই মার্চ তৃণমূল পরিচালিত নতুন বোর্ড শপথ নেয়। চেয়ারম্যান হন কুশল মুখার্জ্জী ও ভাইস চেয়ারম্যান হন বেলি বেগম। নতুন বোর্ডের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে নতুন বোর্ডের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।
শুরু থেকেই গুসকরা পুরসভার অন্যতম সমস্যা হলো নির্দিষ্ট ডাম্পিং গ্রাউন্ডের অভাব। এদিকে শহরের লোকসংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে যত্রতত্র আবর্জনা ছড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন কাজের জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ শহরে আসে। ফলে শহর দূষিত হয়। দৃশ্য দূষণ ঘটে। গৃহস্থলীর জৈব ও অজৈব আবর্জনা সংগ্রহ করার জন্য বর্তমানে পুরসভার পক্ষ থেকে প্রতিটি বাড়িতে দেওয়া হয়েছে নীল-সবুজ বালতি। পুরসভার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মীরা সেগুলি সংগ্রহ করে রটন্তী তলার পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে। পচনশীল ও অপচনশীল পদার্থ পৃথকভাবে ফেলার জন্য দূষণ সমস্যা অনেকখানি দূর হয়েছে। এমনকি সংগৃহীত অজৈব পদার্থ দিয়ে পুরসভার বেশ কিছু নীচু এলাকা ভরাট করা হয়েছে। তবে দৃশ্য দূষণের হাত থেকে বাঁচতে হলে জায়গাটির চারপাশ ঘিরে দিতে হবে বলে দাবি উঠছে ।
প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে পুরবাসীদের পানীয় জলের সমস্যায় ভুগতে হয়। সমস্যা দূর করার জন্য ইতিমধ্যে চারটি ডিপ টিউব ওয়েল বসানো হয়েছে। শোনা যাচ্ছে এপ্রিল মাসের মধ্যে আরও নতুন চারটি বসানো হবে। প্রতিটি বাড়িতে দ্রুত সংযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পুরকর্তৃপক্ষের আশা এরফলে পানীয় জলের সমস্যা অনেকটাই দূর হবে।
শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চোদ্দটি উঁচু বাতিস্তম্ভ বসানোর ফলে রাতের শহর আলোকিত থাকে। শহর জুড়ে প্রায় চার হাজারের মত বৈদ্যুতিক পথবাতি আছে। তবে মাঝে অনেক জায়গায় সেগুলি খারাপ হয়ে যায় এবং সময়মত পাল্টানো হয় না। ফলে তখন সেখানে অন্ধকার থেকে যায়। মূল শহর থেকে দূরের ওয়ার্ডগুলি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত থেকে যায়।
শহরের অন্যতম বড় সমস্যা নিকাশী ব্যবস্থা । আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের জন্য সামান্য বৃষ্টিতেই বেশ কিছু ওয়ার্ডে জল জমে থাকে। সমস্যায় পড়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। দেখার বিষয় হল এই সমস্যা দূর করার জন্য পুরসভা কি ভূমিকা নেয়।
শহরের অধিকাংশ ওয়ার্ডের রাস্তা পাকা বা ঢালাইয়ের হলেও বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে এখনো মাটির রাস্তা দেখা যায়। পাকা রাস্তাগুলো নিয়মিত মেরামত করা হলেও, সাধারণ মানুষের অভিযোগ, নিম্নমানের কাজের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অর্থের অপচয় হয়। মানুষের ক্ষোভ বাড়ে। এদিকে অবশ্যই পুরসভাকে নজর দিতে হবে।
একটা সময় শহরের মধ্যে তিনটি সিনেমা হল রমরমিয়ে চললেও বর্তমানে শহরবাসীর বিনোদনের জন্য একটাও সিনেমা হল নাই। যদিও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একই সমস্যা আছে । শিরিষতলা সংলগ্ন পুরসভার নিজস্ব বিদ্যাসাগর হলের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে আছে। অথচ ঠিকমত ব্যবহার করতে পারলে এখান থেকে পুরসভার একটা আয় হতে পারত বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা ।
শহরের বড় সমস্যা হেঁটে চলাচলের জন্য নাই কোনো ফুটপাত । শহরে টোটো বা মোটর ভ্যানের সংখ্যা বাড়লেও নাই কোনো নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড। যত্রতত্র সেগুলি দাঁড়িয়ে পড়ে। ফলে মাঝে মাঝে যানজটের সৃষ্টি হয়।
প্রতিবছর এই সময় শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশার দাপট বাড়ে। পুরদপ্তরের স্বাস্থ্যকর্মীরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রচারে বের হলেও বা গাপ্পি মাছ ছাড়া হলেও স্প্রে করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ফলে মশার অত্যাচার বেড়েই চলেছে। অবশ্যই পুরসভাকে এই বিষয়ে নজর দিতে হবে।
শিশু ও প্রবীণদের জন্য শহরের মধ্যে দুটি পার্ক আছে। জানা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই ৭ নম্বর ওয়ার্ডে একটি ইকো পার্ক গড়ে তোলা হবে। আগত অতিথিদের রাত্রিবাসের জন্য সেখানে চারটি কটেজও থাকবে। এটা একটা ভাল সিদ্ধান্ত।
চেয়ারম্যান সহ প্রতিটি কাউন্সিলারকে নিয়মিত নিজ নিজ ওয়ার্ড পরিদর্শন করতে দেখা যায়। এখনো পর্যন্ত নেতা সুলভ আচরণ গড়ে না ওঠার জন্য হাতের কাছে তাদের পেয়ে শহরবাসীরা সহজেই অভিযোগ জানানোর সুযোগ পায়।
শুধু শহরবাসীরা নয় শহরের আশেপাশের বহু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার জন্য গুসকরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। বাম আমলের মত তৃণমূল আমলেও শুধুই প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোনো উন্নতি হয়নি। এলাকাবাসীর মধ্যে এনিয়ে একটা আক্ষেপ থেকে গেছে। ইদানীং অবশ্য এটা নিয়ে বেশ নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আপগ্রেডেশনের কাজ শুরু হবে। সত্যিই যদি হয় এটা হবে শহরবাসীর কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা হবে ।
গুসকরা শহরে আর একটা অভাব হলো এখানে কোনো অগ্নিনির্বাপক কেন্দ্র নাই। যদি কোনো কারণে শহরের বুকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চোখের সামনে সবকিছু পুড়ে যাওয়া দেখতে হবে। জানা যাচ্ছে খুব দ্রুত হয়তো গুসকরা পুলিশ ফাঁড়ির কাছে অগ্নিনির্বাপক কেন্দ্র গড়ে উঠতে চলেছে ।
শহরবাসীসহ শহরে আগত মানুষদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন আগেই তো নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। এখনো কেন দেওয়ালগুলোতে রাজনৈতিক স্লোগান শোভা পাবে? পুরসভা কি সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এটা বন্ধ করতে পারে না ? এরফলে তো শহরের সৌন্দর্যায়ন বাড়বে। তাদের মতে,শাসকদল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে এটা শুরু করা উচিত। অনেকের মতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় শৌচাগারের দরকার। নিউটাউনে দরকার যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের।
দিকে দিকে তৃণমূলের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি বা পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও আপাতত এই বিষয়ে গুসকরার পুরসভার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তবে অনেকের মতে আবাস যোজনা প্রাপকদের তালিকা আরও স্বচ্ছ হওয়া দরকার ছিল। ইদানীং একটা অভিযোগ ধীরে ধীরে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। ঠিকেদারির সঙ্গে যুক্ত একশ্রেণির তৃণমূল নেতার নাকি আনোগোনা বেড়েছে পুর দপ্তরে। অনেকের কাছে এটা বেশ দৃষ্টিকটু ঠেকেছে।
পুরসভার চেয়ারম্যান কুশল মুখার্জ্জী বললেন, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কখনোই বলবো না। নিশ্চিত রূপে কিছু সমস্যা তো আছেই। তবে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে শহরবাসীর সমস্যা দূর করতে। তবে বড় সমস্যা অর্থ ও জায়গার অভাব। তিনি আরও বললেন,আমি গর্বিত আমার কাউন্সিলারদের জন্য। প্রতিটি মুহূর্তে যেভাবে তারা শহরবাসীর পাশে থাকে তাতে বোঝা যাবে না এই প্রথমবারের জন্য তারা কাউন্সিলার হয়েছে। শহরবাসীর কাছে তাঁর আবেদন, রাজনৈতিক মতামত দূরে সরিয়ে রেখে কিভাবে আমাদের সবার প্রিয় শহরকে রাজ্য তথা দেশের সেরা করা যায় সেই বিষয়ে সুচিন্তিত পরামর্শ দিন। তিনি বললেন,আগামী দিনে শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে অভিযোগ বাক্স রাখা যায় কিনা সেই বিষয়ে আমরা ভাবনা চিন্তা করব।
রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে তৃণমূল বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি খোঁজার চেষ্টা করলেও দিনের শেষে ভাল-মন্দ বিচার করবে সাধারণ মানুষ। তারাই বলবে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে কিনা বা হলেও কতটুকু হয়েছে। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ভয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে ফিসফিস করে তারা সমালোচনা করলেও সেটা ঝড় হতে বেশি সময় লাগবেনা। ইতিহাস তার সাক্ষী ।।