জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,হুগলি,১৯ ফেব্রুয়ারী : মায়ের স্নেহ-মমতা কী বুঝতে না বুঝতেই মাতৃহারা হয় হুগলি জেলার হরিপালের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রাই । মাত্র তিরিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী না ফেরার চলে যান তার মা স্বর্ণালি দেবী। বিশাল পৃথিবীতে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন শিশুকন্যা রাই ও স্বামী অন্বয়কে। কিভাবে মাতৃহারা শিশু সন্তানকে মানুষ করবেন এটা ভেবে অন্বয় বাবু যখন দিশেহারা তখনই তাকে চমকে দিলেন ছোট্ট মেয়ে রাই। মাকে হারানোর মাত্র পনেরো দিনের মাথায় মা হারানোর যন্ত্রণাকে বুকে চেপে রেখে মায়ের স্মরণে আয়োজিত স্মরণ সভায় সমাজসেবী বাবাকে এক রক্তদান শিবিরের আয়োজন করার অনুরোধ করে রাই। মেয়ের আবেদনে চমকে ওঠেন অন্বয়বাবু ও তার দীর্ঘদিনের সাথীরা। ছোট্ট মেয়ে রাইয়ের অনুরোধকে ফেলতে পারেননি তারা। সেই শুরু। তারপর থেকে প্রতিবছর ১৯ শে ফেব্রুয়ারি হরিপালের অন্বয় দে’র বাড়িতে আয়োজিত হয়ে চলেছে ‘স্বর্ণালি’ স্মরণে স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটলনা।
রক্তদান শিবিরকে সফল করার জন্য,বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী স্পন্দিতা অর্থাৎ রাই নীরবে অসম বয়সী বন্ধুদের কাছে রক্তদান করার জন্য আবেদন করে। বিশিষ্টদের আমন্ত্রণ করে শিবিরে উপস্থিত থাকার জন্য। মাতৃহারা ছোট্ট শিশুর সেই আকুল আবেদন, আমন্ত্রণ এড়াতে না পেরে কেউ ছুটে আসেন সূদুর বাঁকুড়া থেকে, কেউ বা সিঙ্গুর থেকে। সবার ভালবাসা ও আন্তরিকতায় অন্যমাত্রা ধারণ করে স্মরণ অনুষ্ঠানে আয়োজিত রক্তদান শিবির।
শিবিরে রক্তদান করেন ৩২ জন রক্তদাতা । সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় শ্রীরামপুরের শ্রমজীবী হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্ক শাখা। সংগৃহীত রক্ত সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এবারও শিবিরে ‘রাজবলহাট কালচারাল সার্কেলের’ সহযোগিতায় ১০ জন ব্যক্তি মরণোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। প্রত্যেকের সুবিধা অসুবিধার দিকে নজর দিয়ে গ্যাছে সবার প্রিয় ছোট্ট রাই।
বাচ্চা মেয়েটির ডাকে সাড়া দিয়ে রক্তদাতাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য শিবিরে উপস্থিত ছিলেন শ্রীরামপুর শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের সম্পাদক গৌতম সরকার, চিকিৎসক ডা. সুজিত ভট্টাচার্য, স্থানীয় বিধায়ক ড. করবী মান্না, আশুতোষ পঞ্চায়েত প্রধান সুমিত সরকার, সহদেব পঞ্চায়েত প্রধান দেবাশীষ পাঠক, চিত্র পরিচালক অশোক রায়, হরিপাল বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান ড. মৈনাক দে, হরিপাল শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের সম্পাদক সন্দীপন বাবু, রাজবলহাট কালচারাল সার্কেলের পক্ষ থেকে প্রসাদ ঘোষ, মিলন কুমার দে, ক্রীড়াবিদ সৌমেন বাগ, ড. রাজীব ব্যানার্জি, তাপস চৌধুরী, চিরঞ্জীব দে এবং হরিপালের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘এসো বন্ধু হই’-এর সম্পাদক অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সভাপতি প্রসাদ সিংহ রায়, দেবাশীষ দে সহ আরও অনেক শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী।
অন্বয় বাবু বললেন,’ছোট্ট মেয়ের আব্দার ফেলতে পারিনি। মা’হারা মেয়ে প্রত্যেককে রক্তদান করার জন্য অনুরোধ করেছে। আমরা শুধু আনুষঙ্গিক আয়োজন করেছি ।’ এতক্ষণ যে রাই শিবিরে উপস্থিত সবার মনে স্নেহের স্পন্দন সৃষ্টি করে মায়ের মত রক্তদাতাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল নিজের মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে কোনো কথায় বলতে পারেনি সে। হাসিখুশি মেয়েটার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে জল।।