প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৭ ফেব্রুয়ারী : রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চোরাস্রোত বইছিল ? নাকি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নেপথ্যে রয়েছে বালি ঘাট থেকে করে খাওয়া নিয়ে লড়াই! গুলির পর গুলি চালিয়ে পূর্ব বর্ধমানের রায়নার এক তৃণমূল কর্মী ও তাঁর বৃদ্ধ বাবাকে জখম করার ঘটনায় দুই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ওই রহস্যেরই শিকড়ে পৌছাতে চাইছে। যদিও মূল অভিযুক্ত সৌমেন রায় এখও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়েই পালিয়ে বেড়াচ্ছে।তাকে গ্রেপ্তারের পরেই গুলি কাণ্ডের সমস্ত রহস্য পুলিশের কাছে পরিস্কার হয়েযাবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল ।
পুলিশ স্থানীয় সূত্রে জানিয়েছে,বুধবার রাতে গুলিবিদ্ধ হন রায়নার নতু গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা অধীধ শুকুর গ্রাম নিবাসী তৃণমূল কর্মী মৃগাঙ্ক সিং ওরফে লালন (৪০) ও তাঁর বাদল সিং (৭০)। তাঁদের পায়ে গুলি চালিয়ে জখম করার অভিযোগ ওঠে একই গ্রামের বাসিন্দা তরুণ রায় ,হেমন্ত মাঝি ও সৌমেন রায়। বৃহস্পতিবার বেলায় এই তিন অভিযুক্তর বিরুদ্ধে রায়না থানায় লিখিত অভিযযোগ দায়ের করেন মৃগাঙ্কর মেয়ে রুমা সিং। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে একাধীক জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করে তদন্তে নেমে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি ব্যবহৃত গুলির খোল ও একটি কার্তুজ উদ্ধার করে । পুলিশ সেগুলি বাজেয়াপ্ত করেছে।ওই দিন রাতেই অভিযানে নেমে পুলিশ শিয়ালি বাসস্ট্যান্ড থেকে তরুণ ও হেমন্তকে গ্রেপ্তার করে। আগ্নেআস্ত্র ও মূল অভিযুক্ত সৌমেন রায়ের নাগাল পেতে পুলিশ এই দুই ধৃতকে শুক্রবার বর্ধমান আদালতে পেশকরে দশ দিনের পুলিশি হেপাজতের আবেদন জানায় । বিচারক দুই ধৃতকেই সাত দিন পুলিশি হেপাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এসডিপিও (বর্ধমান দক্ষিণ) সুপ্রভাত চক্রবর্তী জানান,দু’জন ধরা পড়েছে। আর এক অভিযুক্ত ধরা পড়লেই স্পষ্ট হয়ে যাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোন রিভালবার থেকে গুলি চালানো হয়েছিল কিনা।
গুলিবিদ্ধ হয়ে বর্ধমান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা মৃগাঙ্ক সিং এর স্ত্রী মুনমুন সিং বৃহস্পতিবার জানিয়েছিলে তাঁর স্বামী সহ শ্বশুর বাড়ির সবাই তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি করেন।ব্লক তৃণমূলের সভাপতি বামদেব মণ্ডল তাঁদের নেতা । বুধবার রাতে যাঁরা তাঁর স্বামী ও শ্বশুর মশাইয়ের পায়ে গুলি করে জখম করেছে তারা গত বিধানসভা ভোটের পর বিজেপি থেকে তৃণমূল হয়ে যায় ।তরুণ রায় ,হেমন্ত মাঝি ও সৌমেন রায় নামে ওই তিন অভিযুক্ত এলাকায় আধিপত্য কায়েম করতে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটিয়েছে বলে মুনমুনদেবী দাবি করেছিলেন। আর বৃহস্পতিবার মৃগাঙ্কর মেয়ে রুমা সিং লিখিত অভিযোগে রায়না থানার পুলিশকে জানান,’বুধবার বেলা আড়াইটা নাগাদ তাঁর বাবা মৃগাঙ্গকে রাস্তায় ফেলে প্রচণ্ড মারধোর করে তরুণ ও হেমন্ত। মারধোরে তাঁর বাবা গুরুতর জখম হন।স্থানীয় মহেশবাটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা করিয়ে তাঁর বাবা মারধোরে যুক্তদের বিরুদ্ধে রায়না থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ পেয়ে থানা মামলা রুজু করে ।এরপর ওইদিনই রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ শুকুর বাজার এলাকায় তরুণ,হেমন্ত ও সৌমেন মিলে ফের তাঁর বাবা মৃগাঙ্ক সিং ও দাদু বাদল সিং কে প্রচণ্ড মারধর করে।তরপর সৌমেন তাঁর লাইসেন্স প্রাপ্ত আগ্নেআস্ত্র থেকে ৮-১০ রাউন্ড গুলি চালায়। রুমা সিং জানায়,তাঁর বাবা ও দাদু গুলিবিদ্ধ হন । এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য সুশান্ত মণ্ডল স্বীকার করেন,’গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে গুলি চালিয়ে আদি তৃণমূল কর্মী বাবা ও ছেলেকে জখম করেছে তিন নব্য তৃণমূল কর্মী তরুণ ,হেমন্ত ও সৌমেন’। যদিও বিরোধীরা দাবি করছেন,বালি ঘাট ও পঞ্চায়েতকে কব্জায় রেখে করা লুটেপুটে খাবে,সেটা নিয়েই রায়নার নতু সহ বিভিন্ন অঞ্চলে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এখন চরমে পৌছেছে ।
রায়নার তৃণমূল বিধায়ক শম্পা ধারা এদিন বলেন, অনেক কিছুই তিনি শুনতে পান।কিন্তু দলের স্বার্থে সেইসব প্রকাশ্যে বলা যায় না।তবে দলের ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে সব জানিয়েছেন।একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন,বুধবার রাতে গুলি চালানোর ঘটনার একদমই গ্রাম্য বিবাদ।এরসঙ্গে রাজনীতির কোন ব্যাপারই নেই।কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে ওই ঘটনাকে ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ বলার চেষ্টা করছে । আর তৃণমূলের রায়না ১ ব্লকের সভাপতি বামদেব মণ্ডলের বক্তব্য,যারা ৩৪ বছর বাংলা শাসন করেছে তারা এখনও বালির মোহ ত্যাগ করতে পারেনি। তবে ওরা হয়তো জানেনা ওদের আমলের চাইতে এখন পঞ্চায়েতে বেশি টাকা আসে। আর সে কারণেই পঞ্চায়েত দখল করাটাই কারুর কারুর কাছে মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ।
বিজেপির বর্ধমান সাংগঠনিক জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্রের কথায়,রায়না, জামালপুর, খণ্ডঘোষ, মঙ্গলকোট, মাধবডিহি, গলসি থানার বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েতের নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় থাকে বালি-খাদান। ওই সব এলাকায় পঞ্চায়েত আর বালি খাদান পরস্পরের পরিপূরক। আর সে কারণেই তৃণমূলের নেতারা জানেন, বালি খাদান দখলে থাকলে পঞ্চায়েত ক্ষমতা আসবে। সে কারণেই ওই সব এলাকায় তৃণমূলের অন্দরে গোলমাল লেগেই আছে।।