প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১২ ফেব্রুয়ারী : চাকরি বিক্রির কোটি কোটি লুট করেছে হাওয়াই চটি । কয়লা পাচার, গরু পাচার, কোষাগার ফাঁকা, খুঁজে দেখো, টালির চালে রাখা আছে জনতার টাকা। মমতা এখন নির্মমতা হয়ে গেছে। তাই এবার পিসি আর ভাইপোকে নমস্কার জানিয়ে দিদিকে ছুটিতে পাঠাতে হবে। রবিবার পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর জনসভা থেকে এই ভাষাতেই এই রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ও তৃণমূল নেত্রীর কঠোর সমালোচনা করলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সবাপতি জে পি নাড্ডা । পাশাপাশি তিনি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূয়সী প্রশংসা করে সভায় উপস্থিত জনতার কাছে বাংলায় পদ্ম ফোটানোর আহ্বান জানান ।
বাংলার রাজনীতিতে এই রবিবারটা ছিল হাইভোল্টেজ রবিবার । আসন্ন পঞ্চায়েত ভোট ও ২০২৪ এর লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে এখন থেকেই একপ্রকার আসরে নেমে পড়েছে বিজেপি। সেই মতোই এদিন জে পি নাড্ডা বাংলার পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ও পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরে জোড়া জনসম্পর্ক সভা করলেন ।হেলিকপ্টারে চড়ে এদিন কলকাতা থেকে পূর্বস্থলীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন নাড্ডা জি। দুপুর সাড়ে বাড়োটার পর পূর্বস্থলীর মাটি ছোঁয় নাড্ডা জির হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই তিনি সোজা চলে যান পূর্বস্থলী থানা সংলগ্ন কালি মন্দিরে । মণ্দিরে পুজো দিয়ে দুপুর ১টা নাড্ডা জি সভামঞ্চে ওঠেন। জনসভার মঞ্চে জে পি নাড্ডা ছাড়াও কেন্দ্রীর পঙ্কজ চৌধুরী,রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রীয় নেতা অমিত মালব্য,সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় ও জগন্নাথ সরকার উপস্থিত থাকেন।
কালি পুজো দিয়ে বেরিয়ে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হন জে পি নাড্ডা ।তিনি তারাপিঠ ও দক্ষিনেশ্বরের উদাহরন টেনে বলেন,’পশ্চিমবঙ্গ শক্তি পিঠের স্থান। আমরা জানি,যখনই অত্যাচার হয়েছে দেবী দেবতারা অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছেন । তৃণমূল পা্টি এখানে যে অত্যাচার করছে তাতে প্রজতান্ত্রিক মূল্য ও ব্যবস্থার হরণ করছে ।দেবী মায়ের আশীর্বাদে বাংলায় যাতে এই অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটাতে পায়ি সেই প্রার্থনা এদিন মাকে জানিয়েছি ,মায়ের কাছে সেই প্রার্থনাও জানিয়েছি ।’
কালি মন্দির থেকে ফিরে জনসভামঞ্চে উঠেও
রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে সুর চড়ান সর্বভারতীর বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা। জনসভায় জনতার ভিড দেখে আপ্লুত নাড্ডাজি বলেন, সভায় জনতার এই ভিড় প্রমাণ করে দিচ্ছে বাংলায় পরিবর্তন আসছে। মমতার রাজত্বে বাংলায় যে জঙ্গল রাজ, অপশাসন চলছে তাকে বাংলার জনতা আলবিদা জানাতে চাইছে। নাড্ডা জি দাবি করেন,,“ মোদীজির নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে। আজ মোদীজির রাজত্বে দশম অর্থব্যবস্থায় ভারত প্রতানিয়াকে পিছনে পঞ্চম স্থানে চলে এসেছে। এটাই হচ্ছে বিকাশ। আগে সবাই জানতেন গাড়ি একমাত্র জাপানই বানায়। অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে জাপানই ছিল এগিয়ে। কিন্তু এখন মোদিজীর রাজত্বে জাপানকে পিছনে ফেলে ভারত গাড়ি ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে তিন নম্বর স্থানে উঠে এসেছে। আজকে আমরা গোটা বিশ্বকে ওষুধ সরবরাহ করছি। গোটা বিশ্বের ’ফার্মেসি’ এখন ভারত বনে গেছে। সবচেয়ে সস্তা এবং জীবন দায়ী ওষুধ এখন ভারতে তৈরি হচ্ছে। আপনাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোন ২০১৪ সালেও ৫২ শতাংশ আসতো চায়না ,ইউরোপ, আমেরিকা থেকে। কিন্তু এখন আপনারা জেনে খুশি হবেন ৯৭ শতাংশ মোবাইল ফোন এখন ভারতেই তৈরি হচ্ছে। অ্যাপেলের মোবাইল ফোনও এখন ভারতে তৈরি হচ্ছে“। নাড্ডা জি বলেন,এইসবের পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মোদীজির নেতৃত্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ভারত এখন এগিয়ে চলেছে । ইউক্রেনের যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জেপি নাড্ডা বলেন,’মোদিজী পুতিন ও জেলেনেস্কির সঙ্গে কথা বলে যুদ্ধ বন্ধ করিয়ে ২২,৫০০ বাচ্চাকে নিরাপদে উদ্ধার করে ভারতে নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে এই পশ্চিমবাংলার ৩০০ বাচ্চাও ছিল ।’
জেপি নাড্ডার বক্তব্য শুনুন
এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটের প্রসঙ্গ সামনে এনে নাড্ড জি বলেন, ’কলকাতা মেট্রো রেলের জন্য এক হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এছাড়াও চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার সেন্টারের জন্য ১৫ কোটি টাকা, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম টেকনোলজির জন্য ৬৩ কোটি টাকা এবং ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট এর জন্য ২৩ কোটি টাকা রাখা হয়েছে’।পাশাপাশি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের আধুনিকীকরণের জন্য ৩৩৫ কোটি টাকা ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার স্যানিটেশনের জন্য ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।এইসব তথ্য তুলে ধরে নাড্ডা জি দাবি করেন, বাংলার প্রতি মোদিজীর ভালবাসা রয়েছে বলেই এত কিছু দেওয়া হয়েছে।
এই রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস দল ও তৃণমূল সরকারের কঠোর সমালোচনা করে জে পি নাড্ডা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর গরিব কল্যাণ অন্য যোজনার
রেশনও টিএমসির কার্যকর্তারা চুরি করেছে। মোদীজি অন্য দিচ্ছে আর টিএমসির লোকেরা দুর্নীতি করে সেইসব খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এই রাজ্যে দিদির প্রশাসন গরিবের জলজীবন মিশনকেও ঠিকভাবে কার্যকর করছে না। মোদীজি চান দেশের কোন মানুষকে যাতে ঝুপড়িতে বা কাঁচা বাড়িতে থাকতে না হয়। সবাই যাতে পাকা বাড়িতে থাকতে পারে তার জন্য মোদি জি, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা শুরু করেছেন। কিন্তু মমতা দিদি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা কে বাংলা আবাস যোজনা বানিয়ে দিয়েছেন। দিদি কিছু দেবে না,কিন্তু নাম চুরি করে নিতে শিখেছে। এখন যখন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা অডিটিং হচ্ছে তখন জানা যাচ্ছে, তৃণমূলের যেসব কার্যকর্তারা পাকা বাড়িতে বসবাস করছে তাদেরকেই ফের প্রধানমন্ত্রী বাংলা আবাস যোজনার বাড়ি দেওয়া হয়েছে।যেসব টিএমসি কার্যকর্তাদের দোতলা -তিন তলা পাকা বাড়ি রয়েছে তােও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর নিচ্ছে।
নাড্ডাজির কথায়, বাংলায় ’আয়ুষ্মান ভারত’ চালু করতে দেওয়া হয় না। তার কারণে এই বাংলার ৪ কোটি ৭৬ লক্ষ মানুষ আয়ুষ্মান ভারত এর সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আয়ুষ্মান ভারত যাতে বাংলার মানুষ পেতে পারে তার জন্য তৃণমূলকে হটিয়ে দিয়ে পদ্মকে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি হতে বলেন নাড্ডা জি। তাঁর আরও অভিযোগ,
“প্রধানমন্ত্রী কৃষাণ সম্মান নিধি যোজনা বাংলায় চালু করতে দিতে চাননি মমতাজি। এই বিষয়টিকে ভারতীয় জনতা পার্টি যখন ভোটের ইস্যু করে তোলে তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিশান সম্মান নিধি শুরু করতে দেয় ।
সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা
টিএমসি পার্টির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, টিএমসি-র ’টি’ হলো তোলাবাজি, টেরর। ’এম’ হল মাফিয়া, মানিলন্ডারিং,আর ’সি’ হল করাপশন, কমিশন।নাড্ডা জির দাবি’ এটাই হলো টিএমসি এর মূল অর্থ“। নাড্ডা জি তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করে আরও বলেন,এই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন মহিলা। বাংলা মহিলাদের উঁচু স্থানে রাখে। কিন্তু মহিলাদের প্রতি অত্যাচারে এই বাংলা গোটা দেশের মধ্যে চার নম্বর স্থান করে নিয়েছে।। মহিলাদের ওপর এসিড এ্যাটাকে বাংলা দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। পণপ্রথার জন্য মহিলা মৃত্যুতে গোটা দেশের প্রথম সারিতে থাকা পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম হল বাংলা। আর মহিলা ট্রাফিকিং মহিলা,কিডন্যাপে বাংলা গোটা দেশের মধ্যে ৩ নম্বর স্থানে রয়েছে। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা সেই রাজ্যে মহিলাদের এমন দুর্গতি!এছাড়াও এসএসসি,টেট,লটারি এইসব দুর্নীতিরও জননী হচ্ছে মমতা সরকার।
জনসভা মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে কটাক্ষ করে জে পি নাড্ডা বাংলা বলেন,’আরে দিদি, আপনার নাম তো মমতা, আপনি কবে থেকে নির্মমতা হয়ে গেলেন। কার্টুন পছন্দ হয়নি বলে, একজনকে জেলে পাঠিয়ে দিলেন। এই হিংসার খেলা কাটমনির খেলা তোলাবাজির খেলা , সিন্ডিকেটের খেলা , টিএমসির খেলা,সব শেষ হবে। দিদি আপনাদের খেলা শেষ হবে। মা মাটি মানুষের সরকার আর নেই দরকার।চাকরি বিক্রির কোটি কোটি লুট হাওয়াই চটি করেছে বলে জে পি নাড্ডা দাবি করেন। একই সঙ্গে তিনি ছড়া কেটে বলেন, “গেরুয়া ঝড় আসছে তেড়ে, ভাগ তৃণমূল বাংলা ছেড়ে’। নাড্জা জির কথায়,দিদি বলেছিল ক্ষমতার এসে ছয় মাসের মধ্যেই শিল্প করবেন । কিন্তু কি হলো দিদি? কোথায় আপনার প্রমিস? দূরবীন দিয়েও বাংলায় শিল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। কয়েকদিন আগেই ‘প্রমিস ডে’ ছিল। কিন্তু দিদি বাংলার মানুষকে দেওয়া ’প্রমিস’ রাখতে পারেনি। দিদি প্রায়ই বলে এগিয়ে বাংলা। দিদি ঠিকই বলে। অত্যাচারে এগিয়ে বাংলা,অপশাসনে এগিয়ে বাংলা, খুনের রাজনীতিতে এগিয়ে বাংলা, দুর্নীতিতে এগিয়ে বাংলা। কয়লা পাচার, গরু পাচার, কোষাগার ফাঁকা, খুঁজে দেখো, টালির চালে লুকিয়ে জনতার টাকা। তাই এবার পিসি ভাইপোকে নমস্কার জানিয়ে, দিদিকে আরাম দিতে হবে ।।