প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১২ ডিসেম্বর : জন্ম দেবার পর ছেলের দুটি হাত নেই দেখে জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন মা।তখন কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছিল দু’হাত না থাকা ছেলেকে শৈশবেই প্রাণে মেরে দিতে। কিন্তু না ,মা বাবা সহ পরিবারের কেউ সেই যুক্তি মেনে নেন নি।উল্টে তাঁরা সবাই মিলে দু’হাত না থাকা ছেলে সুজিত কেই পরম স্নেহে লালন পালন বড় করে তোলেন।আজ ৩৭ বছর বয়সে পৌছে যাওয়া আইটিআই পাসকরা যুবক সুজিত দাঁ-ই এখন তাঁর দুই পা দিয়ে ট্র্যাক্টর চালিয়ে নিজের অন্নের সংস্থান করছেন।সকল প্রতিবন্ধীদের কাছেও সুজিত প্রেরণা হয়ে উঠেছেন ।
সুজিত কোন শহর বা মফশ্বল এলাকার বাসিনা নয়।পূর্ব বর্ধমানের রায়না বিধানসভার প্রত্যন্ত উচালন গ্রামে সুজিত দাঁ এর বাড়ি। তাঁদের যৌথ পরিবার।ছোট বয়সেই সুজিত তাঁর বাবা স্বপন দাঁ কে হারান। বাড়িতে বিধবা মা পুতুলদেবী সহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন।সুজিত জানিয়েছে,হার না মেনে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার প্রেরণাটা ছোট বয়সে তাঁকে যে ব্যক্তি যুগিয়েছেন তিনি হলেন গ্রামের মাস্টার মশাই শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য। পায়ে পেনসিল গুঁজে দিয়ে হাতে করে পা ধরে ওই মাস্টার মশাই তাঁকে লেখা পড়া শিখিয়েছেন।তার পর থেকে পায়ে করে লিখেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পাশাপাশি আইটিআই (ITI) সার্ভে ডিপ্লোমা কোর্সও সম্পূর্ণ করেছেন। সুজিত দাঁ এও জানান,তিনি আইটিআই পাশ কারার পর ডিভিসির চাকরির পরীক্ষায় বসে পাসও করেন।প্যানেলে তাঁর নামও উঠেছিল।কিন্তু ২০১১ সালে রাজ্য রাজনীতিতে পালাবদলের পর সব কোথায় কি হয়ে যায় তার কিছুই তিনি জানতে পারেননি ।
এর পর আর বসে না থেকে এক পরিচিত চালকের সাহায্য নিয়ে তিন দুই পা দিয়েই ট্র্যাক্টর চালানো শেখেন ।সুজিত জানান,ট্র্যাক্টর চালিয়েই তিনি প্রথম উপার্জন করা শুরু করেন।এখন ট্র্যাক্টর চালানোর পাশাপাশি ধানের ব্যবসাও করেন। সম্প্রতি খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে স্পেয়ার পার্টসের ব্যবসাও শুরু করেছেন বলে সুজিত জানান।কিন্তু দোকানে ব্যবসার খাতা সারা,খরিদ্দারকে মালপত্র দেওয়া এসব কাজ করেন কিভাবে? উত্তরে সুজিত জানান, এই সবকিছু তিনি পায়ে করেই করেন।আর অ্যানন্ড্রয়েড ফোন পায়ে ধরে নিয়েই তিনি অন্যের সঙ্গে কথা বলেন।এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক এইসবও তিনি পায়ে করেই করেন। খাওয়া দাওয়া করতে সমস্যা হয় ন?এর উত্তরে সুজিত জানান ,বাড়িতে থাকলে মা খাইয়ে দেন।বাইরে থাকলে চামচ পায়ের আঙুল দিয়ে ধরে নিয়ে খাবার তুলে খান।
প্রতিবন্ধী সুজিত দাবি করেন,”পা দিয়ে তাঁকে সবকিছু করতে হয় বলে তাঁর কোন আক্ষেপ নেই । বরং নিজেকে নিয়ে তিনি গর্ববোধ করেন।কারণ হাত না থাকলেও শুধমাত্র দু’পা দিয়েও যে জগৎতের সবকিছুকে জয় করা যায় ,সেটা তিনি করে দেখাতে পরেছেন”। এত কিছুর পরেও সুজিত দাঁ এর আক্ষেপ,’সরকার বা প্রশাসন কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ালো না ।কোথাও একটা স্থায়ী চাকরি পেলে তাঁর অনেক উপকার হত বলে সুজিত জানিয়েছেন ।
মা পুতুলদেবী বলেন,’’ছেলেকে জন্ম দেবার পর যখন দেখি আমার ছেলের দুটি হাতই নেই তখন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি ।জ্ঞান ফেরার পর শুধুই কেঁদেছি।অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রেপ আমায় সহ্য করতে হয়েছে।পরিবারের সবাই পাশে ছিলবলে ছেলে
সুজিত সমস্ত প্রতিকুলতা কাটিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে“। পায়ে করে লেখাপড়া শিখে ছেলে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা যখন দেয় ওই মাসেই আমার স্বামী মারাযান। পুতুলদেবী গর্বের সঙ্গে বলেন, “নিজের প্রচেষ্টায় ও ঈশ্বরের কৃপায় আজ আমার ছেলে সুজিত শুধু নিজেই সাবলম্বি হয়নি,অন্য প্রতিবন্ধীদেরও জীবন সংগ্রামের দিশা দেখাচ্ছে ।’
সুজিতের ছোট কাকু তুলসি দাঁ বলেন,’দু’হাত না থাকা অবস্থায় ভাইপো সুজিত জন্মানোর পর অনেকেই ওকে প্রাণে মেরে দেবার যুক্তি দিয়েছিল।কিন্তু বাড়ির প্রথম সন্তানের জীবন কেড়ে নেওয়ার যুক্তি তাঁরা কেউ মানেন নি । আজ ভাইপো তাঁর দুটি পা কে সম্বল করেই সাবলম্বি হয়েছে। সাধারণ মানুষ দুই হাতে করে যা যা করে তার ৯০ শতাংশ সুজিত পায়ে করেই করে ।’ তুলসিবাবু জানান,সরকার বা প্রশাসন কোথাও একটা স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দিলে ভাইপো সুজিতের খুবই উপাকার হত।
রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী
প্রদীপ মজুমদার রায়না বিধানসভারই ভূমি পুত্র ।
উচালনের অদূরে কামারহাটি গ্রামে প্রদীপ বাবুর বাড়ি। সুজিত দাঁ এর জীবন সংগ্রামের কাহিনী শুনে মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারও তাজ্জব হয়ে যান।
প্রতিবন্ধী যুবক সুজিতের লড়াইয়কে কুর্ণিশ জানিয়ে, ব্যক্তিগত ভাবে তার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী ।।