শ্যামসুন্দর ঘোষ,মন্তেশ্বর(পূর্ব বর্ধমান),১৩ নভেম্বর : পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীতের মূল তিনটি ধারা হল ভাটিয়ালি,বাউল ও ঝুমুর গান । এই তিন ধারায় রয়েছে প্রায় ২০ প্রকার উপধারা । আর তা নিয়েই গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বাংলার লোকসংগীত । কবি, তরজা, পাঁচালী, সাঁওতালী গান,ঝুমুর,পটুয়া, বারোমাস্যা, গম্ভীরা, ভাদু, টুসু, ভাওয়াইয়া,গাজনের মত উপধারাগুলির মতই তালিকায় রয়েছে বাদাই গান । প্রাচীন কালের কৃষিজীবি নিরক্ষর মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য মূলত ওই সমস্ত গানের উদ্ভব হলেও গানগুলির আড়ালে লুকিয়ে আছে পুরানকাহিনী বা লোকশিক্ষা । কিন্তু আধুনিকতার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে ওই সমস্ত লোকসংগীত গুলি । তবে পশ্চিমবঙ্গের কিছু প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ তাঁদের পুরনো ঐতিহ্যকে আজও ভুলতে পারেননি । সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কিছু লোকসংগীতকে তাঁরা টিকিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন । এই রকমই একটি গ্রাম হল পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি -২ ব্লকের সারগাছি গ্রাম । স্মার্ট ফোনের যুগে এলাকার মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে রবি ও সোমবার এই দুই দিন বাদাই গানের আসর বসিয়েছেন কিছু সংস্কৃতি মনস্ক খেটে খাওয়া মানুষ । গানের এই আসর পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে । ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গ্রামের প্রতিটি মানুষ বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত ।
কমিটির কর্মকর্তা ইমরার শেখ, নজরুল শেখ,তারা রায়,মুজিবর রহমানরা বলেন,’প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের গ্রামে বাদাই গান হয়ে আসছে । তবে মাঝে করোনার জন্য দু’বছর বন্ধ ছিল । এবছর থেকে আবার এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করেছি ।’
প্রসঙ্গত,শুরুতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কাহিনীর উপরেই ভিত্তি করেই বাদাই গান রচিত হত । গানের আসর বসত মূলত গ্রামের নাট মন্দিরে,বারোয়ারি তলায় বা কোনও সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ির উঠনে সামিয়ানা টাঙিয়ে । বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে অভিনয়ের ঢঙে গান গেয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করতেন শিল্পীরা । থাকতো ঢোল,কাঁসি,বাঁশি,বাঁশরী, খঞ্জনি, নুপূর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র । প্রথম দিকে কীর্তনের সুরে বাদাই গান গাওয়া হলেও পরবর্তী কালে টপ্পা, ঝুমুর, গাজনের সুরের অনুপ্রবেশ ঘটে । কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাদাই গানের ভাষা ও সুরে লাগে আধুনিকতার ছোঁওয়া । গানের উপস্থাপনা একই থাকলেও ভাষায় ধর্মীয় কাহিনীর পাশাপাশি জায়গা নিতে শুরু করে লোকশিক্ষা,সমাজচিত্র ।
রবিবার সারগাছি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল কেউ কালো পোশাক পড়ে রাক্ষস সেজে অভিনয় করছেন । কেউ মহিলা সেজে পাড়ায় পাড়ায় গান গেয়ে নেচে নেচে ঘুরছেন । গানের তালে হারমনিয়াম, খোল, খঞ্জনি বাজাচ্ছেন কিছু শিল্পি । শিল্পিদের ঘিরে বাদাই গান উপভোগ করছেন মহিলা,পুরুষ ও শিশুরা । ইমরার শেখ বলেন, ‘গ্রামের মাঝে মঞ্চ করা হয়েছে । রাতে সেখানে মিলিত আসর বসবে । প্যান্ডেল, লাইট, বক্সসহ যাবতীয় খরচখরচা গ্রামে চাঁদা তুলে সংগ্রহ করা হয়েছে । গ্রামের সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন । প্রতিটি পরিবারের আত্মীয় স্বজনরা এসেছেন আমাদের গ্রামের বাদাই গান উপভোগ করার জন্য ।’।