জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,২৫ সেপ্টেম্বর :
পদবী ছিল ‘ঘোষাল’ কিন্তু সেটাই হয়ে গেলো ‘মণ্ডল’ । তার পেছনে আছে মজার কাহিনী। তখন ছিল ইংরেজ আমল। গ্রামের ছোটখাটো বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে বসে মিটিয়ে দিত গ্রামেরই কোনো প্রভাবশালী পরিবার। সাধারণত তাদের ‘মোড়ল’ বলা হতো। পশ্চিম বর্ধমানের সালানপুরের এথোড়া গ্রামের ‘মোড়ল’ ছিল এই ঘোষাল পরিবার। গ্রামের সরল সাদাসিদে মানুষরা তাদের ‘মোড়ল’ বলে ডাকত। কালক্রমে ‘ঘোষাল’ পদবীটা বদলে গিয়ে হয়ে গ্যালো ‘মোড়ল’ অর্থাৎ ‘মণ্ডল’। গ্রামের মানুষের আদরের ডাকটা আজও বংশপরম্পরায় বহন করে চলেছে ঘোষাল পরিবার।
গ্রামে তখন আরও চারটে দুর্গাপুজো হলেও এই ‘মোড়ল’ বাড়ির কোনো দুর্গাপুজো ছিলনা। অথচ গ্রামের মানুষরা তাদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা করত। ফলে বাড়ির মেয়ে-বৌরা হুট করে পাড়ার ঠাকুর দেখতে যেতে কিছুটা সংকোচ বোধ করত। তাছাড়া তারা ঠাকুর তলা দিয়ে গেলে ঠাকুর দেখতে আসা অন্যরা তাদের জায়গা ছেড়ে দিত। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের অস্বস্তি লাগত। সেই অস্বস্তি দূর করার জন্য বাংলার ১২২৭ সালে পরিবারের দুই সদস্য সতীশ মণ্ডল ও রাধানাথ মণ্ডল নিজেদের পরিবারে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। সবার সাহায্য নিয়ে গড়ে ওঠে পাথরের মন্দির। কালের নিয়মে মন্দির জীর্ণ হয়ে পড়লে সেটা সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আজ থেকে বছর তেত্রিশ আগে সেই সংস্কারের কাজ শুরু হয়। তখনই পাওয়া যায় একটি পাথর যেখানে সাল ও দুই সদস্যের নাম পাওয়া যায়। তার থেকেই অনুমান করা হয় ২০২ বছর আগে ‘মোড়ল’ বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল ।
পুজোটা শুরু হয়েছিল তান্ত্রিক মতে। তবে সেখানে রীতি-নীতির কোনো ঘাটতি থাকেনা। যতই হোক ‘মোড়ল’ বাড়ির পুজো।পুজোর আগের দিন থেকেই ফুল ও আলোর মালায় সেজে ওঠে মন্দির চত্বর। মন্দিরের বাইরে নির্মিত হয় প্যাণ্ডেল। প্রথম দিন থেকে ‘মা’ এখানে এক পাটাতেই আসেন। সপ্তমীর দিন ঢোল ও কাঁসর ঘণ্টা সহযোগে ঘট আনা হয়। সেই সময় পরিবারের সমস্ত সদস্যরা তাতে পা মেলায়। অষ্টমী ও নবমী দু’দিনই ছাগ বলি হয়। দশমীর দিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সিঁদুর খেলা। পরিবারের সমস্ত সদস্য এবং বাড়িতে আসা আত্মীয় স্বজনরা তাতে অংশগ্রহণ করে। সেটা এক দেখবার মত দৃশ্য। তবে শত পরিবর্তনের মধ্যেও পরিবারটি তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছে। ‘মোড়ল’ বাড়ির পুজো দেখতে গ্রামের মানুষ ভিড় করে যথেষ্ট।
‘মোড়ল’ পরিবারে আছে কালচারের ছোঁয়া। স্বাভাবিক ভাবেই পুজোর প্রথম দিন থেকে চারদিন চলে সাংস্কৃতিক উৎসব। তাতে পরিবারের সদস্যরা অংশগ্রহণ করে। সঙ্গীত থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের সম্ভার সেখানে দ্যাখা যায়। এমনকি যাত্রাও হয়। পরিবারের পুজোয় মহিলা ও শিশুদের আলাদা উৎসাহ দেখা যায় ।
এখন ‘মোড়ল’ পরিবারে বারোটি আলাদা
ভাগ আছে। অর্থাৎ বারোটি পরিবারের নামে পুজোর সংকল্প হয়। পুজোর সময় সবাই একসঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। যারা কর্মসূত্রে বাইরে থাকে তারাও ফিরে আসে। পরিবারের সব সদস্যদের মিলিত ভিড় দেখে মনে হবে হয়তো কোনো পারিবারিক উৎসব হচ্ছে।
পরিবারের অন্যতম সদস্য কৌশিক মণ্ডল বললেন,’দুর্গাপুজোটা আমাদের ‘ মোড়ল’ পরিবারে একটা আলাদা মাত্রা এনে দেয়। পুজোর আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে সেটা কার্যত ‘মোড়ল’ পরিবারের ‘গেট টু গেদার’ হয়ে ওঠে। এক বছর পর আবার আমরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাই। তখন যে আনন্দটা হয় সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।
প্রসঙ্গত,অপেশাদার যাত্রা জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হলেন কৌশিক বাবু। বছরের বিভিন্ন সময় প্রচুর ‘শো’ করলেও দুর্গাপুজোর আনন্দটা তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। তার বক্তব্য – ‘শো’ করার সুযোগ আবার পাব। কিন্তু পরিবারের যেসব সদস্যরা বাইরে থাকে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটা এক বছর পর হবে ।।