এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৬ আগস্ট : প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের ঠিক এক বছর আগে ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট কলকাতায় সাম্প্রদায়িক হিংসায় যে নরসংহার হয়েছিল তার স্মৃতি আজ ধুসর হয়ে গেছে । হ্যাঁ,আজ থেকে ঠিক ৭৬ বছর আগে এদিন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস”-এর নামে দেশব্যাপী প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন । এই দিনেই শুরু হয়েছিল কুখ্যাত “দীর্ঘ ছুরিকার সপ্তাহ”-এর প্রথম দিনটি । অবিভক্ত বাংলাকে নিয়ে পাকিস্তান তৈরির লক্ষ্যে জিন্নাহ, খাজা নাজিমউদ্দিন ও কলকাতার হোম পোর্টফোলিওর দায়িত্বে থাকা মুখ্যমন্ত্রী হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিলে যে খুনি পরিকল্পনা করেছিল তাতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যায় । মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যে শহরে চার হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান এবং ১,০০,০০০ বাসিন্দা গৃহহারা হন বলে জানা যায় । যা কলকাতা দাঙ্গা বা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস নামেও পরিচিত । এই দাঙ্গার সময়েই হিন্দুদের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গিয়েছিল গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ওরফে গোপাল পাঁঠাকে ।
মুসলিম লিগের জনক জিন্নাহর ডাকা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের সমারোহটি দুপুরের দিকে কলকাতার অক্টারলোনি মনুমেন্টের কাছে শুরু হয় । তৎকালীন বাংলায় এই সমাবেশটিকে মুসলিমদের সর্ববৃহৎ সমাবেশ হিসাবে মনে করা হয় । পুলিশ ও গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ মানুষ এই সমাবেশে এসেছিল । তবে সংখ্যাটা আরও বেশি ছিল বলে কোনো কোনো সুত্র দাবি করে । সমাবেশে অংশগ্রহনকারী প্রত্যেকেই লোহার রড,লাঠি ও বাঁশ হাতে নিয়ে এসেছিল বলে দাবি করা হয় ।
তবে কলকাতা শহর জুড়ে উত্তেজনা ছড়ায় সমাবেশ শুরুর অনেক আগে থেকেই । ওইদিন সকাল থেকেই রাজাবাজার, কলাবাগান, কলেজ স্ট্রিট, হ্যারিসন রোড বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড, কলুটোলা এবং বড়বাজারের হিন্দুদের দোকানগুলোকে জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল । প্রতিবাদ করলেই লাঠিসোঁটা,ইঁটপাটকেল অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে হামলা চালাচ্ছিল মুসলিম জনতা । সকল ১০টার আগেই সদর পুলিশ দপ্তর লালবাজারে দাঙ্গার খবর এসে পৌঁছায়। তবে পুলিশ ছিল নীরব দর্শক । দুপুরের নামাজ শেষ হলে দুটোর দিকে সমাবেশ শুরু হয় । চলে নাজিমউদ্দিন ও সোহরাওয়ার্দীর উত্তেজক ভাষণ । সমাবেশ শেষে কলকাতার সমস্ত অঞ্চল জুড়ে মুসলমানদের মিছিল শুরু হয় । আর তারপরেই ব্যাপক আকার ধারন করে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ।
পরের দিন অর্থাৎ ১৭ আগস্ট মেটিয়াব্রুজের লিচুবাগান এলাকার কেসোরাম কটন মিলসের প্রায় ৩০০ জনের অধিক ওড়িয়া শ্রমিকদের নৃসংসভাবে হত্যা করা হয় । ওই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয় গার্ডেন রিচ টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি সৈয়দ আবদুল্লাহ ফারুকী এবং কট্টরপন্থী মুসলিম দুষ্কৃতী এলিয়ান মিস্ত্রি । তবে ঠিক কতজনকে ওইদিন হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না । কোনো কোনো মহলের দাবি মেটিয়াব্রুজের এই হত্যাকাণ্ডে প্রায় ১০,০০০ বা তার বেশি মানুষ মারা যায় । হত্যাকান্ডের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি ছিল ১৭ আগস্ট । সারাদিন হত্যাকাণ্ড চলার পর বিকেলের দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলিতে সেনা মোতায়েন করা
হয় । কিন্তু শহরের বাকি অংশ ছিল অসুরক্ষিত ।
এদিকে দু’দিন ধরে দাঙ্গা চলার পর ১৮ আগস্ট থেকে প্রতিরোধ শুরু করে হিন্দুরা । হিন্দুদের রক্ষা করতে ৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সশস্ত্র ভারতীয় জাতীয় বাহিনী গড়ে তোলেন গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ওরফে গোপাল পাঁঠা । লাঠি,রড, ছুরি,তলোয়ার, আগ্নেয়াস্ত্র প্রভৃতি অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পালটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে ওই বাহিনী । গোপাল পাঁঠার স্পষ্ট নির্দেশ ছিল একটি খুনের বদলে দশটি খুন করতে হবে । শেষে কয়েকদিন দাঙ্গা চলার পর গোপালের বাহিনীর রুদ্র রূপ দেখে শান্তির প্রস্তাব দেয় মুসলিম লীগা ।
মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য মুজিবুর রহমানের ও মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার নেতা জিজি আজমিরি, গোপালকে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন । তারপর বন্ধ হয় এই সাম্প্রদায়িক হিংসা । তবে ওই সাম্প্রদায়িক হিংসায় কংগ্রেসের তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভূমিকা ছিল রহস্যে মোড়া । ওয়াকিবহাল মহলের মতে শুরুর দিন থেকেই যদি নেতারা দাঙ্গার রাশ টানতে সক্রিয় হতেন এবং জিন্নাহ ও সোহরাওয়ার্দীকে চাপে রাখতেন তাহলে এত সংখ্যক মানুষের প্রাণহানী আটকানো যেত । তার পরিবর্তে ওই সমস্ত নেতারা কোনো এক অজানা কারনে নিজেদের কার্যত গুটিয়ে নিয়েছিলেন । অবশ্য হিন্দুদের তরফে পালটা প্রতিরোধ হতেই তাদের মধ্যে আবার দাঙ্গা আটকানোর জন্য তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় বলে তাঁরা জানান ।।
তথ্যসূত্র ও ছবি : সৌজন্যে গুগুল ।