দিব্যেন্দু রায়,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),১০ আগস্ট : মা-বাবা তখন জমিতে ধান রোয়ানোর কাজ করছেন। তাঁদের মাস তিন চারের শিশুটি বসিয়ে রেখেছেন জমির আলে । শিশুটির মাথার উপরে কেবল একটি ছাতা খাটানো । তীব্র গরমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে শিশুটি ঘুমিয়ে পড়েছে । তারপর সে ঘুমের মধ্যে কখন যে ছাতার বাইরে চলে এসেছে তা খেয়াল করেননি কাজে ব্যস্ত থাকা তার বাবা-মা । কিন্তু ওই পথ দিয়ে বাইক নিয়ে যাওয়ার সময় বিষয়টি নজরে পড়েছিল এক মুসলিম যুবকের । আর তখনই তিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওই সমস্ত শিশুগুলির জন্য কিছু করার শপথ নিয়ে ফেলেন ।
স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে তৈরি করিয়ে ফেলেন ছোট ফোল্ডিং তাঁবু । পরের দিন সেই তাঁবু হস্তান্তর করেন শিশুর বাবা-মায়ের হাতে । পাশাপাশি শিশুটির জন্য কিছু নতুন পোশাক ও বিস্কুটও কিনে দেন ওই যুবক । পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার থানার মুরাতিপুরের বাসিন্দা শেখ আমিরের এই প্রকার মানবিকতায় আপ্লুত শিশুর মা-বাবা । তবে এই ব্যবস্থা শুধু একটি শিশুর জন্যই নয়,ভিন রাজ্য থেকে এলাকায় কাজে আসা সকল আদিবাসী দম্পতির শিশুদের জন্যই বলে জানিয়েছেন ওই যুবক । শুধু তাই নয়,ভবিষ্যতে যাতে খেতমজুর বাবা মা তাঁদের শিশুকে গাছের ছাওয়ায় শুইয়ে রাখতে পারে তার জন্য জমির মালিকের হাতে মেহেগনি ও কদম গাছের চারা তুলে দিয়ে এসেছেন জমির আলে লাগানোর জন্য । ওই মুসলিম যুবকের এই প্রকার অভিনব ও মানবিক উদ্যোগ প্রশংসা কুড়িয়েছে এলাকায় ।
জানা গেছে,গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে আমন ধান রোয়ানোর কাজ চলছে । প্রতি বছরের মত এবছরেও বর্ধমানের গ্রামে গ্রামে ঝাড়খন্ড এবং বিহার থেকে খেতমজুরের দল এসেছে ধান রোয়ানোর কাজের জন্য । মুরাতিপুরের বাসিন্দা জনৈক এক চাষির কাজে এসেছে ঝাড়খন্ডের ১০-১৫ জনের একটি দল । ওই দলের সঙ্গে এসেছেন লকাই মূর্মু ও সুকুদি মূর্মু নামে এক দম্পতি । তাঁদের সঙ্গে রয়েছে ৩-৪ মাসের একটি শিশু । মঙ্গলবার বাদশাহী রোডের কিছুটা পাশে একটি জমিতে ধান রোয়ানোর কাজ করছিলেন ওই দম্পতি । জমির আলে একটি ছাতা খাটিয়ে শুইয়ে রেখেছিলেন তাঁদের শিশুসন্তানকে । তারপর ঘুমের ঘোরে শিশুটি কখন যে ছাতার বাইরে চলে এসেছিল তা খেয়াল করেননি ওই দম্পতি ।
শেখ আমির বলেন, ‘বাদশাহী রোড ধরে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় শিশুটিকে রোদের মধ্যে শুয়ে থাকতে দেখে খুব খারাপ লেগেছিল । তখন আমার মাথায় আসে ট্রাক্টরের ছাউনির মত ফোল্ডিং ছোট তাঁবু তৈরির পরিকল্পনা । ফিরে এসে পলিথিন কিনে আনি । স্থানীয় এক কারিগরকে দিয়ে তাঁবুর কাঠামো তৈরি করাই । তারপর দর্জিকে দিয়ে পলিথিন লাগানো হয় । পরে মাঠে গিয়ে ওই আদিবাসী দম্পতির হাতে তাঁবুটি তুলে দিই ।’
প্রসঙ্গত,মুরাতিপুরের বাসিন্দা শেখ আমিরকে পশুপাখি প্রেমী বলে চেনে এলাকার বাসিন্দারা । ইতিপূর্বে বহুবার তাঁকে অসুস্থ ও দূর্ঘটনাগ্রস্থ পশুদের রাস্তা থেকে তুলে এনে চিকিৎসা করাতে দেখা গেছে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের পকেট থেকেই ওই সমস্ত খরচ খরচা চালিয়ে আসছেন তিনি । তবে আদিবাসী জনমজুর দম্পতিদের শিশুসন্তানদের জন্য তাঁবু তৈরি,পোশাক ও খাবার কিনে দেওয়ার খরচখরচা তাঁর বন্ধু মুরাতিপুরের সাহিন শেখ, সরাইটিকরের বাসিন্দা সুমন শেখ ও বর্ধমানের নার্সিংহোম মালিক ইনসান মণ্ডল বহন করছেন বলে জানিয়েছেন আমির । তিনি বলেন, ‘আরও তাঁবু তৈরি করা হচ্ছে । শিশুদের পোশাক কেনা আছে । আস্তে আস্তে সব হস্তান্তর করবো ।’ তিনি আফসোস করে বলেন, ‘চাষিরা যদি নিজেরা একটু উদ্যোগী হতেন তাহলে খেতমজুরদের শিশুদের এভাবে কষ্ট সহ্য করতে হত না ।’।