প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৫ জুলাই : শরীরের শিঁড়দাড়ায় বাসা বেধেছে জটিল অসুখ ।তবুও তা দমিয়ে রাখতে পারেনি খুদে আবৃত্তিকার ঐন্দ্রিলা বসুকে।মায়াবী কন্ঠে পরিবেশন করা তাঁর আবৃত্তিতে মুগ্ধ আট থেকে আশি সকল দর্শক ও শ্রোতারা।আর তারই দৌলতে পঞ্চম শ্রেণীতে পাঠরতা ঐন্দ্রিলা নানা মহল থেকে প্রশংসা যেমন কুড়িয়েছে তেমনই পেয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্মান।মিলেছে নানা পুরস্কার ও মানপত্র । তবে এত কিছুর পরেও মেয়ের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁর দরিদ্র বাবা ও মা । মেয়ের জন্য লড়াই করতে করতে তাঁদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে । মেয়ের চিকিৎসার খরচ যোগাড় করতে গিয়ে পরিবারটিও এক প্রকার সর্বসান্ত । তাই মেয়েকে সুস্থ করে তোলার জন্য ঐন্দ্রিলার বাবা মা সবার সহযোগীতা প্রার্থনা করেছেন ।
বর্ধমান ২ ব্লকের বড়শুল ২ পঞ্চায়েত অধীন ব্রাহ্মণপাড়ায় ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি । সেখানকার অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে বছর দশ বয়সী এই কন্যা । তাঁর বাবা সুমন্ত বসু পারিবারিক যতসামান্য জমিতে চাষাবাদ করেন। এ ছাড়াও তিনি ১০০ দিনের কাজও করেন ।ঐন্দ্রিলার মা বিথীকাদেবী সাধারণ গৃহবধূ ।বাড়িতে ছয় বছর বয়সী ঐন্দ্রিলার ছোট ভাই ঐশিকও রয়েছে।ছোট বয়সে কেউ ঐন্দ্রিলাকে আবৃত্তি করা শেখায় নি । তবুও তিন বছর বয়স থেকেই কবিতা আবৃত্তি করার প্রতি অসীম আগ্রহ তৈরি হয় ঐন্দ্রিলার।নিজের প্রচেষ্টায় ঐন্দ্রিলা আবৃত্তিতে নিজেকে দক্ষ করে তুলে সকলের মন জয় করে নেয় । আবৃত্তিতে নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়ে সে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছে ।ঘরের আলমারিতে থরে থরে সাজানো রয়েছে সেইসব পুরস্কার ও ট্রফি।দুবছর আগে ওডিশার কটকে হওয়া আবৃত্তি প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে ঐন্দ্রিলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের পুরস্কারও পেয়েছে।আবৃত্তি পরিবেশনের জন্য এখন অনেক জায়গা থেকে ঐন্দ্রিলার কাছে প্রস্তাব আসে।কিন্তু পারিবারিক অভাব অনটন ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর আর সেই সব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া হয় না ।তা নিয়ে ঐন্দ্রিলা আক্ষেপও করে।
ঐন্দ্রিলা যে অসুখে ভুগছে সেটা সাধারণ কোন অসুখ নয়। সুমন্ত বাবু জানিয়েছেন,“ঐন্দ্রিলার বয়স যখন ৮ মাস ,তখনই তার শারীরিক অসুস্থতা ধরা পড়ে।সুমন্ত বাবু বলেন, তাঁর মেয়ের স্পাইনে কঠিন সমস্যা রয়েছে । এখন তার শিঁড়দাড়া ১০৫ ডিগ্রি বাঁকা। সেই কারণে পায়ে দাড়াতে গেলেও ঐন্দ্রিলার সমস্যা। এছাঢ়াও হামস্ট্রিং ছোট, ফ্রেক্সিবলও নয়। আগের বর্ধমান, বোলপুর, কলকাতা, মুম্বাইয়ে মেয়েকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। ২০১৭ সাল থেকে দিল্লির ’এইমস’ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।মাসে দুবার দিল্লি যাতায়াত করতে হয় মেয়ের চিকিৎসার জন্য।সুমন্ত বাবু এও জানান,তিনি তাঁর মেয়েকে সাইকেলে চাপিয়ে স্কুলে নিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে দেন। আবার কখনও হুইল চেয়ারে বসিয়েও মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যান। টিফিনের সময়েও স্কুলে মেয়ের কাছে যেতে হয়।মেয়ে একভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকলে অসুবিধা হয় বলে মাঝে মধ্যে মেয়ের পা ঠিক করে দিতে হয়। সুমন্তবাবু জানান, এইমসের ডাক্তার বাবুরা পাঁচটা টেস্ট করাতে দিয়েছিল। এমআরআই, ইকো, পালমোনলজি করা হয়েছে। সামনে ১৮ তারিখ ফের ’এইনসে’ অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ওই দিন নিউরোসার্জেন ক্লিয়ারেন্স দেবেন।সেখানে ইউএসজি করা হবে। ২১ তারিখ সিদ্ধান্ত হবে স্পাইনের অপারেশন হবে কীনা। তারপর পায়ের অপারেশন হতে পারে ।
আক্ষেপ প্রকাশ করে সুমন্ত বাবু বলেন,মেয়ের
চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে তাঁর জমানো টাকা সব শেষ হয়ে গিয়েছে। আগামী দিনে কী ভাবে সাংসার চালাবেন তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় করছেন।প্রথম থেকে শুভানুধ্যায়ী শ্বেতা চট্টোপাধ্যায়, মাধব ঘোষ, অনামিকা কোনার, লিপিকা নাগ, শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী, কাশীনাথ গঙ্গোপাধ্যায়রা পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে, তাই এখনও মেয়ের চিকিৎসা করিয়ে যেতে পারছেন বলে সুমন বসু জানিয়েছেন ।
শারীরিক অসুস্থতা যাই থাক আবৃত্তি করার ইচ্ছা একটুও কমেনি ঐন্দ্রিলার।ঐন্দ্রিলা বলে, আমি বর্ধমান, কলকাতা, কটকসহ নানা জায়গায় আবৃত্তি করেছি। স্টেজে আবৃত্তি করতে খুব ভাল লাগে। অনলাইনেও অনুষ্ঠান করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আমার প্রথম পছন্দ।তাছাড়াও নজরুল ইসলাম, সুকুমার রায়, শুভ দাশগুপ্ত, শুভ্রা ঘোষের কবিতা আবৃত্তি করতে আমার খুব ভাল লাগে। আমার আবৃত্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। বাবা-মা-কে খুব কাছে পাই। পাশাপাশি শিখা আন্টি, সুদেষ্ণা আন্টি, সুদীপ্তা আন্টি, সুমিতা আন্টি, স্মৃতিপর্ণা ম্যামদের কাছে পাচ্ছি ।’।