প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৯ জুলাই : ফিজ মাত্র ২০ টাকা।তাও দিতে পারলে ভালো, না দিতে পারলেও কোন রাগ নেই ডাক্তারবাবু গীষ্পতি চক্রবর্তীর । অভিঞ্জ এই চিকিৎসক বর্ধমানের ডাক্তার বাবুদের সাম্রাজ্যে বসেই ত্রিশ বছরেরও বেশী সময়কাল ধরে মাত্র ২০ টাকা ফিজ নিয়ে রোগী দেখে আসছেন। রোগীরা কেউ বলেন ডাক্তার গীষ্পতি চক্রবর্তী ঈশ্বরের পাঠানো দূত। আবার কেউ ওনাকে আল্লার দূত বলে মনে করেন।তবে যাঁর প্রশংসায় রোগীরা পঞ্চমুখ সেই চিকিৎসক যদিও জানিয়েছেন ,অর্থ নয় -রোগীকে সুস্থ করে তুলে তাঁদের মুখো হাঁসি ফোটানোই তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত ।
দক্ষিণেশ্বরে আদি বাড়ি গীষ্পতি চক্রবর্তীর । ডাক্তারি পড়তে এসে তিনি বর্ধমানে বাঁধা পড়ে গিয়েছেন।বর্ধমানের মিঠাপুকুর এলাকার সোনার কালিবাড়ির পাশে রয়েছে জৌলুশ হীন গীষ্পতি বাবুর গরিবের ডাক্তারখানা। সপ্তাহের পাঁচদিন সেখানেই রোগী দেখেন।বাকি দু’দিন কখনো রসিকপুরে আবার কখনো টিকরহাটে বসে রোগী দেখেন । তবে যেখানে বসেই তিনি রোগী দেখুন না কেন, ফিজ তাঁর ২০ টাকাই । বছরের পর বছর ধরে এই ভাবে কম ফিজ নিয়ে রোগী দেখে যাওয়ার জন্য গীষ্পতি বাবুর মনে কোন অনুতাপ নেই ।বরং দূর্মূল্যের বাজারে ২০ টি ফিজ নিয়ে রোগী দেখেও তিনি তৃপ্ত থাকেন । তাঁর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর হাঁসি মুখটাই তাঁকে মুগ্ধ করে ।
গীষ্পতি চক্রবর্তী শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক নন ।তিনি পত্রিকা সম্পাদক ,গল্পকার ও প্রাবন্ধিকও।যাদবপুরে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়ার পরে শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় তিনি বর্ধমান মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে আসেন।পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ সেন্টারে প্রধান চিকিৎসক হিসেবে তিনি চাকরি নেন।সেই থেক প্রায় চার দশক ধরে তিনি বর্ধমান শহরেই রয়েছেন।
তিনি রোগ প্রতিরোধের উপরেই সবথেকে বেশী জোর দেন। গ্রামে গ্রামে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার কাজেও তিনি জড়িয়ে রয়েছেন । সুন্দরবনে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকে জোরদার করে তুলতে আজও তিনি সময় করে সেখানে ছুটেযান । জনস্বাস্থ্য বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি পত্রপত্রিকাতেও তিনি লেখেন । ’স্বাস্থ্য ও মানুষ’ পত্রিকার সম্পাদকও তিনি। সুস্থ থাকার উপায় লেখনি আকারে তিনি ওই পত্রিকায় তুলে ধরেন । শিবশঙ্কর সেবা সমিতিতে আজও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার প্রত্যন্ত গ্রাম ঠাঙাপারা। এই গ্রামের দরিদ্র মহিলা হাসিনা বিবি লিভার রোগে আক্রান্ত। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে তিনি বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।শেষে ডাক্তারবাবু গীষ্পতি চক্রবর্তীর কাছে নিখরচায় চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে তিনি বাঁচার শক্তি ফিরে পেয়েছেন। সুস্থ হয়ে উঠলেও ডাক্তার বাবুকে সামন্য ফিজ না দিতে পারার আক্ষেপ রয়ে গিয়েছিল হাসিনা বিবির । কিছুদিন আগে তিনি তাঁর ছেলের কাছ থেকে ১ কেজি সুগন্ধি চাল চেয়ে নিয়ে গীষ্পতি ডাক্তারবাবু চেম্বারে হাজির হন । ডাক্তার বাবুর হাত দুটি ধরে হাসিনা বিবি ডাক্তার বাবুর হতে উপহার স্বরুপ সেই এক কেজি চাল তুলে দেন। সেই উপহার গ্রহনের সময়ে ডাক্তারবাবুর চোখে জল চলে আসে ।
হাসিনা বিবিকে তিনি বলেন,’আমি সহ নাগরিক ও একজন চিকিৎসচ হিসেবে আমার কর্তব্য পালন করেছি’। পাল্টা ডাক্তারবাবুকে প্রণাম জানিয়ে হাসিনা বিবি বলেন,’আপনি গরিবের ডাক্তার।আল্লাহই গরিবের জন্য আপনাকে পাঠিয়েছে ’। রোগীনির মুখ থেকে এই কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যান ডাক্তারবাবু ।’
রোগীদের কথায় জানা গিয়েছে, ডাক্তার গীষ্পতি চক্রবর্তী প্রথম থেকে মাত্র দশ টাকা ফিজ নিয়েই রোগী দেখতেন। পরে তাঁর কাছে আসা রোগীদের চাপেই তিনি তাঁর ফিজ ২০ টাকা করেন। রোগীদের বক্তব্য , ডাক্তার গীষ্পতি চক্রবর্তী একেবারে মাটির মানুষ । তাঁর সাথে প্রাণখুলে কথা বলা যায়। রোগীদে নিজের আপন লোক ভেবে ডাক্তারবাবু তাঁদের পরামর্শ নেন। কেউ ফিজ দিতে না পারলেও ডাক্তার বাবু কোন আক্ষেপ করেন না ।উল্টে গরির রোগীদের তিনি ওষুধের স্যাম্পল ফাইল দিয়ে সহায়তা করেন।
গীষ্পতিবাবু বলেন,বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরি করতাম ।এখন পেনশন পাই। তাতেই তো আমার দিব্যি চলে যায়। এর পরেও রোগীদের থেকে মোটা টাকা ফিজ নেওয়ার কি দরকার আছে আমার । রোগীদের সুস্থ করে তেলেই আমি আনন্দ পাই ।’ আর এই কাজটুকু নীরবেই করে যেতে চান বলে ডাক্তার বাবু মন্তব্য করেন ।।