প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৯ মে : ভিন ধর্মের যুবকের সঙ্গে প্রেম করা মেয়েকে নৃশংস ভাবে হত্যার দায়ে বাবা ও দাদাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা দিল আদালত। বৃহস্পতিবার বর্ধমান আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক ফাস্ট কোর্টের বিচারক সুব্রত চট্টোপাধ্যায় এই সাজা ঘোষনা করেন । সাজা প্রাপ্তরা হলেন নিহত তরুনী জাহানা খাতুন (১৯) এর বাবা মহম্মদ মুস্তাক ও দাদা মহম্মদ জাহিদ। তাঁদের বাড়ি বিহারের মুজাফ্ফর জেলার মোশাহারি ব্লক থানার চকএলাহাদাদ গ্রামে।লাভ জেহাদের জেরে হওয়া নজিরবিহীন এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচারকের রায়ও নজিরহীন বলে মনে করেছেন বর্ধমান আদালতের আইনজীবীদের একাংশ ।
বর্ধমান আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে,ঘটনাটি ২০১৮ সালের ৩১ আগষ্টের । ওই দিন সকালে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার নবগ্রাম-ময়না এলাকায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ের ধার থেকে উদ্ধার হয় তরুণী জাহানা খাতুনের রক্তাত মৃত দেহ।ওই দিনই পুলিশ মৃতদেহটি ময়না তদন্তে পাঠায় । ময়নাতদন্তের পর পুলিশ জানতে পারে ,ওই তরুণীকে প্রথমে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করা হয় ।পরে মৃত্যু নিশ্চিৎ করতে তরুণীর মাথায় ভারী পাথর দিয়ে আঘাত করা হয়। ময়নাতদন্তকারীরা পুলিশকে এও জানায়,মেহেন্দি দিয়ে তরুনীর পায়ে তিনটি মোবাইল ফোন নম্বার ও ’করণ ’ বলে কারুর নাম লেখা রয়েছে । পুলিশ ওইসব ফোন নম্বার ও নামটি ময়নাতদন্তকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে । পাশাপাশি পুলিশ খুন ও তথ্য প্রমাণ লোপাটর চেষ্টার ধারায় মামলা রুজু করে মহিলার মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে নামে । তদন্তে নেমে জামালপুর থানার তদন্তকারী অফিসার ১০ দিনের মধ্যে খুনের ঘটনার মূল অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে ফেলেন । কলকাতার পার্কসার্কাস সংলগ্ন বেনিয়াপুকুর এলাকা থেকে পুলিশ প্রথম তরুণীর দাদা মহম্মদ জাহিদ কে গ্রেফতার করে। তাঁকে জেরা করে পুলিশ তরুণীকে খুনের ঘটনার তাঁর বাবা মহম্মদ মুস্তাকের জড়িত থাকার কথাও জানতে পার। এরপর পুলিশ কলকাতার তিলজলা এলাকায় হানা দিয়ে মহম্মদ মুস্তাককে গ্রেপ্তার করে । দুই জনকে থানায় বসিয়ে জেরা করে পুলিশ জানতে পারে ’করণ’ হল তরুণী জাহানা-র প্রেমিক । সে ভিন ধর্মের জেনেও জাহানা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল । চকএলাহাদাদ গ্রামে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েও পুলিশ জাহানার সঙ্গে করণের প্রেম ভালবাসার বিষয়ে সবিস্তার খোঁজ খবর নেয় ।এর পরেই পুলিশ নিশ্চিত হয় ,ভিন ধর্মের যুবকের সঙ্গে মেয়ের প্রেম ভালবাসা মেনে নিতে পারে নি তাঁর বাবা, দাদা ও গ্রামের মাতব্বররা।তাই তারা জাহানা কে খুনের পরিকল্পনা কষে ফেলে ।
পরিকল্পনা মাফিক ২০১৮ সালের ৩০ আগষ্ট
জাহানাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে চড়ে কলকাতার পার্কসার্কসের বাড়ি থেকে রওনা হয় দাদা জাহিদ ও বাবা মহম্মদ মুস্তাক । জাহিদ পুলিশকে জানায় ,সে গাড়ি চালাচ্ছিল । আর তার বাবা মহম্মদ মুস্তাক ও বোন জাহানা ওই গাড়ির অপর আসনে বসেছিল ।ওই গাড়িতেই তাঁর বাবা জাহানাকে শ্বাসরোধ করে প্রাণে মেরে দেন। পরে সন্ধ্যা নাগাদ তারা জামালপুরের নবগ্রাম ময়না এলাকায় জাতীয় সড়কের ধারের নির্জন জায়গায় গাড়ি দাঁড় করান ।অন্ধকার রাস্তার ধারে জাহানার দেহ গাড়ি থেকে নামিয়ে ঝোপের মধ্যে তাঁরা ফেলেদেন ।এরপর মৃত্যু নিশ্চিৎ করতে মোস্তাক ভারি পাথর দিয়ে মেয়ে জাহানার মাথা থেঁতলে দেন।এর পর বাবা ও ছেলে একই গাড়িতে চেপে পুনরায় কলকাতায় পালিয়ে যান। তবে এত পরিকল্পনা এঁটেও শেষ রক্ষা হয় নি।মেহেন্দি দিয়ে তরুণী তাঁর পায়ে যে তিনটি মোবাইল ফোনের নম্বর
লিখে রেখে ছিল সেই ফোননম্বারই তাঁকে খুনের ঘটনায় জড়িতদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয় ।
সরকারী আইনজীবী সন্দীপ কুমার ভট্টাচার্য্য
বলেন,’লাভ জেহাদের জেরেই ঘটে এই খুনের ঘটনা। নিজের মেয়েকে খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতের নির্দেশে বর্ধমান সংশোধনাগারে ঠাঁই হয়েছিল নিহত তরুণীর বাবা মহম্মদ মুস্তাক ও দাদা মহম্মদ জাহিদের । বিচার প্রক্রিয়ায় গোপন জবানবন্দি দেয় তরুণীর প্রেমিক করণও । এছাড়াও পুলিশি তদন্তে উঠে আসা সমস্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারক তরুণীর বাবা মহম্মদ মুস্তাক ও দাদা মহম্মদ জাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করেন ।এদিন তাঁদেরই নজিরহীন সাজার কথা শেনান বিচারক । পাশাপাশি তাঁদের মোট ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে । জরিমানা অনাদায়ে তাঁদের নির্দিষ্ট আরো কয়েক মাস কারাবাসে থাকতে হবে বলে বিচারক তাঁর রায়ে জানিয়ে দিয়েছেন ।’ অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবীরা অবশ্য এই রায়ে খুশি নন। তাঁরা এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলে জানিয়েছেন ।।