এইদিন ওয়েবডেস্ক,কাবুল,১৯ মে : আফগানিস্তানের তালিবান সরকার মহিলাদের জনসমক্ষে তাদের মুখ ঢেকে রাখার নির্দেশ জারি করেছে । প্রপাগেশন অফ ভার্চ্যু অ্যান্ড দ্য প্রিভেনশন অফ ভাইস মন্ত্রকের তরফ থেকে জারি করা নির্দেশে বলা হয়েছে,যদি কোনও মহিলা বাড়ির বাইরে তার মুখ ঢেকে না রাখেন তবে তার বাবা বা নিকটতম পুরুষ আত্মীয়কে প্রথমে সতর্ক করা হবে । পরে জরিমানা এমনকি জেল বা সরকারি চাকরি থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হতে পারে । মহিলাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে,১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবানদের পূর্ববর্তী শাসনাকালে মহিলাদের জন্য যে নীল বোরখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল সেটিই যেন তারা মেনে চলেন । এদিকে তালিবানের এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন আফগান মহিলারা । নারী অধিকার কর্মীদের মতে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অগ্রগতি দুই দশক পিছিয়ে যাবে । বর্তমান বিধিনিষেধের ফলে আফগানিস্তানের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৫ শতাংশ বা এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে বলে অনুমান করছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) ।
দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর আফগানিস্তানে ১২ বছরের উর্ধে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে । পুরুষদের সাথে মহিলাদের পার্কে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে । পরিবারের পুরুষ সদস্য ছাড়া মহিলাদের বাসে ভ্রমন নিষিদ্ধ । “নতুন পরিকল্পনা” প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগ দিতে নিষেধ করা হয়েছে । ট্যাক্সি চালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে সমস্ত মহিলারা নির্ধারিত “ইসলামিক ড্রেস কোড” অনুসরণ করবে না তাদের যেন পরিষেবা না দেওয়া হয় । এছাড়া খেলাধুলায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তালিবান সরকার ।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে ডি ফ্যাক্টো তালিবান শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগে লক্ষ লক্ষ আফগান মেয়ে স্কুল কলেজে নাম নথিভুক্ত করেছিল । তার জন্য স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৮০,০০০ মহিলা প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল । জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তখন সামগ্রিকভাবে প্রায় ৪ লাখ আফগান বেসামরিক কর্মচারীদের মধ্যে এক লাখেরও বেশি মহিলা ছিলেন। আফগানিস্তান উইমেনস চেম্বার অফ কমার্স ২০২১ সালের মার্চ মাসে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল । তাতে বলা হয়েছিল, দেশে ৫০,০০০ মহিলা মালিকানাধীন ব্যবসা রয়েছে । তার মধ্যে ১৭,৩৬৯ টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসা থেকে দেশে মোট ১,২৯,০০০ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছিল । যার তিনচতুর্থাংশেরও বেশি ছিল মহিলাদের হাতে । বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুসারে,এর প্রায় ৩ গুণ মহিলাকর্মী ছিল ২০২০ সালে । তখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে আফগান মহিলা কর্মীদের অংশগ্রহণের হার ছিল ২১.৮ শতাংশ ।
গত বছর তালিবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার আগে আফগানিস্তান ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ । মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯ -এর মধ্যে ১৬৯ স্থানে এবং লিঙ্গ সমতা সূচকে ১৬২-এর মধ্যে ১৫৭ নম্বরে ছিল আফগানিস্তান । ২০২১ সালের আগস্ট থেকে প্রসূতি ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিষেবা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দ্রুত হারে বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলেছে । এর মাঝে মহিলাদের কর্মসংস্থানের উপর বর্তমান বিধিনিষেধের ফলে আফগানিস্তানের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৫ শতাংশ বা এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে বলে অনুমান করছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) । মেয়েদের যত বেশি সময় ধরে পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্র থেকে দুরে সরিয়ে রাখা হবে সময়ের সাথে সাথে এই সংখ্যাটা তত দ্রুত হারে বাড়বে বলে মনে করছে ইউএনডিপি । তালিবানি শাসনে প্রভাব পড়েছে আফগান মিডিয়ার উপরেও । আফগান মিডিয়ার ৪০ শতাংশ বন্ধ থাকায় এবং ৮০ শতাংশ মহিলা সাংবাদিক তাদের চাকরি হারানোয় সংবাদমাধ্যমও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের মাঝামাঝি নাগাদ প্রায় ৯ লাখ মানুষ কর্মহীন হবে আফগানিস্তানে । তার মধ্যে মহিলাদের কর্মসংস্থান কমবে ২১ শতাংশের মত ।
আফগান নারী অধিকার কর্মী এবং উদ্যোক্তা পাশতানা দোরানি(Pashtana Dorani) বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা জারি করার মত তালিবানের কাছে আর কিছু অবশিষ্ট নেই । বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এই সব কিছু করছে তালিবানরা । তারা জানে নিজেদের প্রাসঙ্গিক প্রমাণ করার এটাই একমাত্র সহজ উপায় ।’ দোরানির কথায়, ‘নিয়ম না মানায় কিছু মহিলা উদ্যোগপতির পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে । ফলে বেশ কিছু মহিলা মালিকানাধীন ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে । মহিলাদের অধিকার সীমিত হয়ে যাওয়ায় দেশে সব কিছুই কমতে শুরু করেছে । তালিবানি নেতারা নিজেদের মেয়েকে স্কুলে কলেজে পাঠাচ্ছে আর এদিকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দার জন্য সাধারণ আফগান মহিলাদের জীবন যন্ত্রণাদায়ক করে তুলেছে । এটা দেখেও কষ্ট হয় ।’।