জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গুসকরা(পূর্ব বর্ধমান),২১ এপ্রিল : মাঠের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা। বল পায়ে মাঠের বামপ্রান্ত ধরে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চলেছেন এক খর্বাকায় মানুষ। তার গতির কাছে হার মেনে ততক্ষণে বিপক্ষের ডিফেন্ডাররা যথেষ্ট পেছিয়ে পড়েছে। কর্ণার ফ্লাগের কাছাকাছি পৌঁছে নিজের দলের স্ট্রাইকারদের উদ্দেশ্যে বক্সের মধ্যে করলেন ছোট্ট একটা ‘চিপ’। অথবা কখনো কখনো ‘কাট’ করে নিজেই ঢুকে যাচ্ছেন ভিতরে। মুহূর্তের মধ্যে ঝলসে উঠছে বাঁ-পা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাল থেকে বল কুড়িয়ে আনা ছাড়া বিপক্ষের অসহায় গোলরক্ষকের আর কিছু করার থাকত না । বিপক্ষে যেই দলই থাকুক না কেন ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার গুসকরা ও তার আশপাশের অসংখ্য ফুটবল প্রেমী মানুষ। কলকাতা ময়দানের ‘কালো মানিক’ মোহনবাগান জনতার হৃদয়ের মণি বিদেশ বসু যদি তার আগে খেলা শুরু করতেন হয়তো তার মধ্যেই ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ আর এক বিদেশ বসুকে খুঁজে পেত। তিনি হলেন খেলোয়ারী জীবনে বিপক্ষ ডিফেন্ডারদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক গুসকরা বড়বাগান এ্যাথলেটিক ক্লাবের লেফট উইংগার মানিক কর্মকার- কারও কাছে তিনি মানিক ‘দা’ অথবা মানিক ‘স্যার’ নামে পরিচিত ।
পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল গুসকরা মহাবিদ্যালয় থেকে। সেখানেও খেলোয়াড় তৈরি করার টানে মেতে ওঠেন। এলাকার ফুটবলারদের স্বার্থে গড়ে তোলেন ‘গুসকরা জোনাল স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন’। পাশ্ববর্তী গ্রামগঞ্জের ফুটবল টিম নিয়ে চালু হয় লিগ প্রতিযোগিতা। সেখান থেকে সেরা ফুটবলার দিয়ে নিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব টিম । গুসকরার সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস ‘ফকিরচাঁদ শিল্ড’ সহ বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় সেই টিম অংশগ্রহণও করে । এমনকি বেশ কিছু ফুটবলার বর্ধমানের বিভিন্ন ক্লাবে সুযোগও পায় । শুধু তাই নয় খেলা পাগল মানুষটি বিভিন্ন এলাকায় ফুটবল প্রতিযোগিতায় রেফারির ভূমিকাও পালন করেছেন ।
কয়েক বছর আগেও বিদ্যালয়ের ছুটির শেষে গ্রামগঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে শহরের খেলার মাঠগুলো পরিপূর্ণ থাকত। ফুটবল, ক্রিকেট সহ বিভিন্ন খেলার অনুশীলনে মেতে থাকত একদল যুবক। তারপর ধীরে ধীরে ভাঁটা পড়তে থাকে। খেলার মাঠগুলো বৃক্ষ শূন্য মরুভূমির মত খেলোয়ার শূন্য অবস্থায় পড়ে থাকে। নিজের সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গড়ে তোলার নেশায় মত্ত অভিভাবকরা তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে ভুলে গেল। কিন্তু নিয়মিত খেলার মাঠে হাজিরা দিতে ভোলেননি পঁচাত্তর অতিক্রম করা ‘যুবক’ মানিক কর্মকার ।
কেউ থাকুক না থাকুক প্রতিদিন বিকেলে গুসকরা কলেজ মাঠে গেলেই দ্যাখা যাবে তাকে। বাস্কেট বল অনুশীলনী মাঠে একদল ছেলেমেয়েকে অনুশীলনে সাহায্য করেন তিনি । কখনো বা নিজেই ঝাঁটা হাতে মাঠ পরিস্কার করতে নেমে পড়েন। এভাবেই নিজেকে সর্বদা ব্যস্ত রাখেন।
মানিক বাবু বললেন,’একটা সময় গুসকরার সমস্ত খেলার মাঠগুলো ভর্তি থাকত। কিন্তু এখন সব ফাঁকা । মুষ্টিমেয় খেলা পাগল যুবক ছাড়া খেলাকে ভালবেসে সেভাবে কেউই আর মাঠে আসেনা। দেখে খুব খারাপ লাগে। আমাদের চেয়ারম্যান নিজেও খেলাধুলা ভালবাসতেন । তাকে অনুরোধ করব যাতে গুসকরাতে ওয়ার্ড ভিত্তিক ফুটবল ও ক্রিকেট লিগ সহ অন্যান্য ইনডোর গেম প্রতিযোগিতা শুরু করা যায় । তাতে হয়তো খেলার জগতে গুসকরা তার অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
এই বয়সেও নিয়মিত মাঠে যাওয়ার জন্য মানিক বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে গুসকরা পুরসভার চেয়ারম্যান কুশল মুখার্জ্জী বললেন,’অবশ্যই আমরা মানিক বাবুর ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করার চেষ্টা করব। খুব শীঘ্রই এই এলাকার অতীতের দিকপাল খেলোয়াদের সঙ্গে আলোচনায় বসে কিভাবে খেলার জগতে গুসকরার অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যায় সেই নিয়ে রুট ম্যাপ তৈরি করব । আমাদের কাউন্সিলদের মধ্যে একজন ফুটবলার আছেন । তাকে এব্যাপারে দায়িত্ব দেবো । আশাকরি সবার সহযোগিতায় আবার আমরা খেলার জগতে আমাদের অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাব ।’।