প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৮ এপ্রিল : তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন একটি হাসপাতাল।আর সেই হাসপাতাল পুনরায় চালুর জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন শতায়ুর দোরগোড়ায় পৌছে যওয়া এক বৃদ্ধ। লড়াকু ওই বৃদ্ধ হলেন পূর্ব বর্ধমানের পাঁচড়া গ্রাম নিবাসী গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় । গরিব ও দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসার স্বার্থে এক বৃদ্ধর এমন আপোশহীন লড়াই চালিয়ে যাবার বিষয়টি নেটিজেন মহলেও সাড়া ফেলে দিয়েছে ।
গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের বয়স এখন ৯৩ ছুঁয়েছে।বার্ধক্যে শারীরিক শক্তি কমলেও কমেনি তাঁর মনের জোর। আর সেই মনের জোরকে সম্বল করেই তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর গ্রামে তালাবন্ধ হয়ে পড়েথাকা শতাব্দী প্রাচীন একটি হাসপাতাল চালুর জন্যে ।অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক শুরুদাসবাবু মূলত আইনি পথে ও সামাজিক ভাবেই এই লড়াই চালাচ্ছেন। গরিব দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসার স্বার্থে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই লড়াই জারি রাখার ব্যাপারেও দৃৃঢ় প্রত্যয়ী গুরুদাস বাবু।তাই পাঁচড়া গ্রামের সাধারণ মানুষজনও তাঁর এই লড়াইয়ের সাথী হয়েছেন ।
এলাকাবাসীর কথায় জানা গিয়েছে ,দেশ তখন পরাধীন।১০৫ বছর আগে ১৯১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাঁচড়া গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় দ্বারোদঘাটন হয় হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়ের। সর্বসাধারণের চিকিৎসার স্বার্থে এই চিকিৎসালয়টি তৈরির ব্যাপারে মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন এলাকারই বধূ হৈমবতী মুখোপাধ্যায়।তাই তাঁর নামেই চিকিৎসালয়টির নামকরণ হয়। ব্রিটিশ রাজত্বে তৎকালীন বর্ধমানের ডিভিশনাল কমিশনার ডি. এইচ . লিস (D .H. Lees) এই হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টির শুভ উদ্বোধন করেছিলেন । সূচনা লগ্নে একাধীক ডাক্তার ও কমপাউন্ডার এই চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা পরিষেবা দেবার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। চিকিৎসালয়ে রেখে রেগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও ছিল ।পাঁচড়া গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গ্রামের বহু মানুষজন চিকিৎসা পরিষেবা পাবার জন্য এই চিকিৎসালয়েই হাজির হতেন ।
দেশ স্বাধীন হবার পর চিকিৎসালয়টির আরো
মনোন্নয়ন ঘটবে এমনটাই সবার প্রত্যাশা ছিল । কিন্তু তা আর হয় না । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সময় যত গড়ায় চিকিৎসালয়ে পরিষেবা ততই দুর্বল হতে শুরুকরে চিকিৎসক ও কমপাউন্ডার ঘাটতির কারণে।পরে অবিভক্ত বর্ধমান জেলাপরিষদ চিকিৎসালয়টি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল জেলা ভাগ হয় ।তার পরেও পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিদের তত্বাবধানে একজন মাত্র চিকিৎসকের উপর নির্ভর করে চলছিল হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টি।২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওই চিকিৎসক অবসর নেন। তারপর থেকেই হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টি তালা বন্ধ হয়েই পড়ে রয়েছে।সেই কারণে এখন চিকিৎসা পরিষেবা পেতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে পাঁচড়া সহ আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের ।এখন চিকিৎসা পরিষেবা পাবার জন্য এলাকার বাসিন্দাদের হয় ১০ কিমি দূরে জামালপুর ব্লক হাসপাতাল ,নয়তো ১২ কিমি দূরে মেমারি গ্রামীণ হাসপাতাল বা ৩০ কিমি দূরের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। দুর্ভোগ এমন বাড়ার জন্য পাঁচড়ার বাসিন্দারাও ক্ষোভে ফুঁষছেন ।
পাঁচড়ার বাসিন্দা রাজু ঘোষ ও শ্রীকান্ত নন্দী
জানিয়েছেন,’হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টি
থেকে পাঁচড়া সহ ২০ থেকে ২২ টি গ্রামের মানুষজন চিকিৎসা পরিষেবা পেতেন । যতদিন হাসপাতালটি চালু ছিল প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন মানুষ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য আসতেন।যে হাসপাতালের ’হেরিটেজ হাসপাতাল ’ হিসাবে স্বীকৃতি পাবার কথা ছিল সেই হাসপাতাল এখন তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে ।তার কারণে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে এখন সবাইকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ।অথচ সব জেনেও প্রশাসন,জেলাপরিষদ বা স্বাস্থ্য দফতর কেউই কোন হেলদোল দেখাচ্ছে না।
হাসপাতালটি চালুর দাবিতে স্থানীয়রা পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখানো থেকে শুরু করে নবান্নে চিঠি পর্যন্ত লেখেন।কিন্তু রাজ্য সরকারও বিষয়টি নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি বলে পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগে জানিয়েছেন।একই সঙ্গে তাঁরা জানান,’তাঁদের গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টি পুণরায় চালু করার জন্য সামাজিক ভাবে ও আইনি পথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। গুরুদাস বাবুর এই লড়াইয়ে তাই পাঁচড়া সহ আশেপাশের বাসিন্দারাও সামিল হয়েছেন ।
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়।তিনি বেলুর মঠের দীক্ষিতও।গুরুদাস বাবু জানিয়েছেন,চিকিৎসা পরিষেবা পাবার ক্ষেত্রে এলাকার গরিব দুঃস্থ মানুষজন নির্ভরশীল ছিলেন হৈমবতী দাতব্য চিকিৎসালয়ের উপরেই ।সেই হাসপাতাল বন্ধ হয়ে পড়ে থাকায় এলাকার গরিব মানুষরা চরম বিকাপে পড়ে গিয়েছেন।ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী একজন মানুষ হয়ে গরিব মানুষের প্রতি প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের এই অবহেলা তিনি মেনে নিতে পারেন নি ।তাই হাসপাতালটি চালু করার জন্য তিনি কলকাতা হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছেন । পাশাপাশি সামাজিক ভাবেও জনমত সংঘটিত করে হাসপাতাল চালুর দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। জনস্বার্থে হৈমাবতি দাতব্য চিকিৎসালয় চালুর জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই লড়াই চালিয়ে বলে জানিয়েদেন দৃৃঢ় প্রতয়ী বৃদ্ধ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় ।
এই লড়াইয়ে গুরুদাস বাবুর পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁর স্ত্রী রেখাদেবী এবং কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী দুই ছেলে রবীশংকর ও উদয়শংকর । জেঠার লড়াইয়ে সাথী হয়েছে আইনজীবী ভাইপো সুমনশংকরও । আইনজীবী রবিশংকর চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন ,“সরকার যাতে পাঁচড়ার শতাব্দী-প্রাচীন হৈম্যবতী দাতব্য চিকিৎসালয়টি অধিগ্রহণ করে সেই দাবিতে তাঁর বৃদ্ধ বাবা জনস্বার্থ মামলা করেছেন ।এই মামলা সংক্রান্ত রিপোর্ট আদালতে পাঠানো নিয়ে ‘গড়িমসি’ করার জন্য রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতরকে ’২৫ হাজার টাকা’ জরিমানা করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। রবিশংকর বাবু আরো জানান,এই মামলার সরকার পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী তপন মুখোপাধ্যায় আদালতে জানান, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়তে ন্যূনতম ৩০ হাজার জনসংখ্যার প্রয়োজন। সেখানে পাঁচড়াতে জনসংখ্যা ২২ হাজার বলে জানান সরকার পক্ষের আইনজীবী ।এই প্রসঙ্গে রবিশংকর বাবু বলেন,২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পাঁচড়ার ওই জনসংখ্যা ধরলে হবে না।তাই কিসের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য দফতর পাঁচড়ার ওই জনসংখ্যা দাবি করা হচ্ছে তার রিপোর্ট রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও পূর্ব বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে আদালত চেয়েছেন ।
যদিও বিষয়টি আদালতের বিচার্য বিষয় বলে জানিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কোন আধিকারিক। একই ভাবে জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বাগবুল ইসলামও আদালতের বিচার্য বিষয় নিয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেন ।তবে তিনি জানিয়ে দেন,’এই বিষয়ে আদালত যেমন নির্দেশ দেবে সেটা আমরা মেনে চলবো ।’।