🌺 একদিন শ্ৰীরামকৃষ্ণ তাকে পরীক্ষাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করলেন’কি গো তুমি কি আমায় সংসারপথে টেনে নিতে এসেছ?’ শ্রীমা বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে উত্তর দিলেন, ‘না, আমি তােমাকে সংসারপথে কেন টানতে যাব? তােমার ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি।’ শ্রীমাও একদিন ঠাকুরের পদসেবা করতে করতে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমাকে তােমার কি বলে মনে হয়?’ ঠাকুর তার উত্তরে বলেন,’যে মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এ শরীরের জন্ম দিয়েছেন ও এখন নহবতে বাস করছেন, আর তিনিই এখন আমার পদসেবা করছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রূপ বলে তােমায় সর্বদা সত্য সত্য দেখতে পাই।’ এ যে তাদের মুখের কথা নয়, অন্তরের সত্যদৃষ্টি, তার অগ্নিপরীক্ষাও শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদাদেবী জগতের কাছে দিয়ে গেছেন ৷ শ্রীমা বেশ কিছুদিন শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহে তাঁরই পাশে রাত্রে নিদ্রা যেতেন ।
দেহবােধ-বিরোহিত শ্রীরামকৃষ্ণের প্রায় সারা রাত সমাধিতেই কাটত। এইসময় নিদ্ৰত শ্রীমাকে পাশে দেখে একবার তিনি নিজেকে এইভাবে পরীক্ষা করেছিলেন; ‘মন, এরই নাম স্ত্রী শরীর । লােকে একে পরম উপাদেয় ভােগ্য বস্তু বলে জানে এবং ভোগ করবার জন্য সর্বক্ষণ লালায়িত হয়। কিন্তু একে গ্রহণ হলে দেহেই আবদ্ধ থাকতে হয়, সচ্চিদানন্দঘন ঈশ্বরকে লাভ করা যায় না। ভাবের ঘরে চুরি করাে না; পেটে একখানা মুখে একখানা রেখাে না। সত্য বল, তুমি একে গ্রহণ করতে চাও, অথবা ঈশ্বরকে চাও ? যদি একেই চাও, তাে এই তােমার সুমুখে রয়েছে, নাও।’ এই বলে হাত প্রসারিত করা মাত্র মন বাহ্যভূমি ত্যাগ করে সমাধিতে বিলীন হয়ে গেল। সে-রাত্রে তার মন আর সাধারণ ভূমিতে নেমে এল না।
ঠাকুরের এই সময়কার দিব্যভাব সম্বন্ধে শ্রীমা বলেছেন,’সে যে কি অপূর্ব দিব্যভাবে থাকতেন, তা বলে বােঝাবার নয়। কখনও ভাবের ঘােরে কত কি কথা, কখনও হাসি, কখনও কান্না, কখনও একেবারে সমাধিতে স্থির হয়ে যাওয়া—এই রকম সমস্ত রাত। সে কি এক আবির্ভাব আবেশ! দেখে ভয়ে আমার সর্বশরীর কাঁপত, আর ভাবতুম কখন রাতটা পােহাবে। ভাব-সমাধির কথা তখন তাে কিছু বুঝি না ।’ পরে শ্রীরামকৃষ্ণই মাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন,’এই রকম ভাব দেখলে কানে এই নাম শােনাবে, এই রকম ভাব দেখলে এই বীজমন্ত্র শােনাবে ।’ তারপর থেকে ঐ সব নাম আর বীজ শােনালেই তার হুশ ফিরে আসত। একাদিক্রমে আট মাস শ্রীমা ও শ্রীরামকৃষ্ণ এক শয্যায় শয়ন করেছেন। পরে যখন শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝলেন যে, কখন তার কি ভাবসমাধি হবে এই ভেবে শ্রীমা সারারাত ঘুমােতে পারেন না, তখন তাঁর জন্য আলাদা ঘরে (নহবতে) শােবার ব্যবস্থা করে দিলেন ।
শুধু শ্রীরামকৃষ্ণ নয়, পবিত্রতাস্বরূপিণী শ্রীমার অপূর্ব চরিত্রমহিমাও আমাদের এখানে স্মরণে রাখতে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন যে, ‘ও (শ্রীমা) যদি এত ভাল না হতাে, …তাহলে সংযমের বাঁধ ভেঙে (তারও) দেহবুদ্ধি আসত কিনা, কে বলতে পারে?
রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার কর্তৃক প্রকাশিত ‘আমি মা সকলের মা’ পুস্তক থেকে সংগৃহীত ।