জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,০৮ মার্চ : একে কি বলা যাবে – সাহিত্য-সাধক অথবা সাহিত্যপ্রিয় মানুষ যারা সাহিত্যকে ভালবেসে প্রকৃত সাধকের মতই প্রচারের আড়ালে থেকে তুলে আনছেন একের পর এক কবি-প্রতিভা? গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারি থেকে কলকাতায় শুরু হয়েছে ৪৫ তম আন্তর্জাতিক বইমেলা। প্রতিদিনই বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠী হাজির হচ্ছে তাদের কাব্য সম্ভার নিয়ে। ক্যামেরার ঝলকানি ও লক্ষ মানুষের ভিড়ে খোলা মঞ্চের রঙিন পরিবেশে প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন কাব্য গ্রন্থ। আর ওদিকে গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে প্রচারের আলোর বাইরে থেকে শহর থেকে অনেক দূরে পত্রিকা গোষ্ঠীর কোনো সদস্যের ঘরের এক চিলতে জায়গায় সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকা। এখানে নাই কোনো কৃত্রিম আনন্দ, নিজের উপহার নিয়ে চলে যাওয়ার তাড়া। কিন্তু আছে আন্তরিকতা।
এই আন্তরিকতাকে পুঁজি করেই গত ৬ ই মার্চ কয়েকজন সাহিত্যপ্রিয় মানুষের উপস্থিতিতে ভাষাসরিৎ সাহিত্য পরিবারের সহ-সভাপতি মধুমিতা হালদারের মধ্যমগ্রামের বাড়িতে ঘরোয়া ও অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রকাশিত হয় ‘ভাষাসরিৎ’ পত্রিকার পঁয়ত্রিশ-তম বছরের প্রথম সংখ্যা। তিনশতের অধিক কবিতা থেকে বেছে নেওয়া প্রায় নব্বইয়ের বেশি কবির সেরা কবিতা স্হান পেয়েছে বইটিতে। প্রসঙ্গত অর্থের অভাবে যে সব প্রতিভা তাদের লেখা প্রকাশ করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েন তাদের জন্য এই পত্রিকা এগিয়ে আসে। এছাড়াও দশ জন কবির রচনা সমৃদ্ধ, শিরোনামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, যৌথ সংকলন ‘মুক্ত মনের কাব্য’ প্রকাশিত হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মধুসূদন সেনগুপ্ত, কাকলি চ্যাটার্জ্জী, অদিতি মুখার্জ্জী সেনগুপ্ত, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, পারমিতা রাহা হালদার, কেয়া দাস, কৃষ্ণা গুহ, রানি প্রভা গুহঠাকুরতা প্রমুখ একগুচ্ছ কবি। পত্রিকা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সম্পাদক নদেরচাঁদ হাজরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সভাপতি সুনীতা হাজরা, সহ-সভাপতি মধুমিতা হালদার, নার্গিস পারভীন সহ অন্যান্যরা। সুদূর রাজস্হানে নিজের কর্মস্থলে থেকে অনুপস্থিতির মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়ে গেছে ভারতীয় সীমা সুরক্ষা বলের তরুণ জওয়ান মারুফ খান। দেশমাতৃকাকে রক্ষার জন্য এক হাতে তার যেমন অস্ত্র থাকে তেমনি সাহিত্যকে ভালবেসে অন্য হাতে তিনি কলমও তুলে নেন। বর্তমান যুগে এরকম সাহিত্যানুরাগী মানুষ সত্যিই বিরল।
দামি উপহার নয়, আন্তরিকতার মাধ্যমেই উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে উপস্থিত অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। হাতে তুলে দেওয়া হয় মানপত্র। আটপৌরে ঘরোয়া পরিবেশে প্রত্যেকে মেতে ওঠে সাহিত্য আলোচনায়। পারস্পরিক সাহিত্য আলোচনায় প্রত্যেকে নিজেদের অভিজ্ঞতা উজার করে দ্যান। কথায় কথায় কখন যে দীর্ঘ সময় কেটে যায় টেরই পাওয়া যায়নি। শহরের চৌহদ্দির বাইরে এক অসাধারণ সাহিত্য বিষয়ক আলোচনার সাক্ষী থাকার সুযোগ পান কয়েকজন।
প্রিয় শিক্ষকের প্রেরণায় একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই পেশায় শিক্ষক সম্পাদক নদেরচাঁদ হাজরা কাব্য সৃষ্টিতে মেতে ওঠেন। লিখতে শুরু করেন ছোট ছোট আঞ্চলিক কবিতা। কলেজ জীবনের শুরুতেই প্রকাশ করেন নিজস্ব পত্রিকা। পরবর্তীকালে শিক্ষিকা সহধর্মিনী সুনীতা হাজরা নিয়মিত উৎসাহ দিয়ে যান। ফলে তার পক্ষে পত্রিকা প্রকাশের কাজটি সহজ হয়ে ওঠে। একসময় পাশে পেয়ে যান মধুমিতা, নার্গিস এবং সর্বোপরি মারুফের মত একগুচ্ছ কাব্য-সাহিত্য প্রিয় উৎসাহিদের। সবার উৎসাহে এবং সহযোগিতায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে চলেছে এই পত্রিকা।
উপস্থিত প্রতিটি কবি এবং সাহিত্য পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে নদেরচাঁদ বাবু বলেন – কলকাতা বইমেলার আকর্ষণকে দূরে সরিয়ে রেখে যেভাবে অতিথিরা হাজির হয়েছেন তাতে আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। খাতায়-কলমে আমি সম্পাদক হলেও প্রত্যেকেই পত্রিকাটিকে একান্তভাবে নিজের মনে করেন বলে আজও প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে এবং আগামীকালও হবে। যেভাবে তরুণ জওয়ান মারুফ কর্মক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করে চলেছেন তাতে তিনি মুগ্ধ। তিনি মনে করেন মারুফদের হাত ধরেই বাংলা কাব্য জগতে একদিন বিপ্লব আসবে এবং বাংলা কাব্য-জগত সমৃদ্ধ হবে ।।