জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বর্ধমান,০৬ মার্চ : নিজে ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে অ্যাডমিট কার্ড পৌঁছে দিয়ে অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন পূর্ব বর্ধমানের রথতলা মনোহর দাস বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর মাধ্যমিক পরীক্ষা। ইতিমধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে অ্যাডমিট কার্ড তুলে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার জন্য অনেকেই সময়মত অ্যাডমিট কার্ড নিতে আসতে পারেনি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হাতে সেগুলি তুলে দেওয়া হয়। তারপরেও গত ৫ ই মার্চ প্রধান শিক্ষক লক্ষ্য করে দেখেন তার বিদ্যালয়ের দুই ছাত্র দীপক দাস ও রাজ মাহালদার অ্যাডমিট কার্ড নেয়নি। গরীব ঘরের ছেলে রাজের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধান শিক্ষক তাদের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ছাত্র বিদ্যালয়ে হাজির হয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে সে পরীক্ষায় বসতে রাজি হয় ।
বহু কষ্টে অপর ছাত্র দীপকের বাড়ির সন্ধান পেয়ে প্রধান শিক্ষক স্বয়ং তার বাড়িতে হাজির হয়ে জানতে পারেন দীপক বিজয়ওয়ারাতে আছে। ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধান শিক্ষক তাকে পরীক্ষায় বসতে পরামর্শ দেন। সেও প্রথমে রাজী হয়নি। শেষ পর্যন্ত রাজী হয় এবং প্রধান শিক্ষক তার অভিভাবকের হাতে অ্যাডমিট কার্ড তুলে দেন। জানা যাচ্ছে দীপক ইতিমধ্যে কোনো রকম সংরক্ষণ ছাড়া ট্রেনে বিজয়ওয়ারা থেকে যাত্রা শুরু করেছে। পরিস্থিতি যা তাতে হয়তো দীর্ঘপথ অতিক্রম করে তার পক্ষে প্রথম দু’টি পরীক্ষা নাও দেওয়া হতে পারে।
দুটি ছাত্রের অভিভাবকদের বক্তব্য – আমরা গরীব মানুষ। ভাবতে পারিনি প্রধান শিক্ষক নিজে আমাদের বাড়িতে আসবেন। তার সম্মান রাখতে আমরা ছেলেদের পরীক্ষা দিতে বলেছি। আমরা প্রধান শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞ।
সরকারি শিক্ষক হিসাবে প্রায় কুড়ি বছর অতিক্রান্ত হলেও পদার্থবিদ্যার স্নাতকোত্তর বিনায়ক বাবু জীবন শুরু করেছিলেন আংশিক সময়ের শিক্ষক হিসাবে এবং প্রথম থেকেই তিনি ছাত্র দরদী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। কর্মস্থল ছিল গুসকরা পি.পি.ইনস্টিটিউশন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, গুসকরা মহাবিদ্যালয় এবং মানকর মহাবিদ্যালয়। নিজের পাঠদানের গুণে এবং বন্ধু সুলভ মনোভাবের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসাবে প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তরুণ শিক্ষক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি শিশুসুলভ আচরণের জন্য শিক্ষকরাও তাকে স্নেহ করতেন। অবশেষে এস.এস.সির হাত ধরে প্রায় কুড়ি বছর আগে যোগ দেন বর্ধমানের ইছলাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছাত্র বান্ধব হিসাবে সেখানেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সরকারি শিক্ষক হিসেবে নতুন হলেও বিদ্যালয়ের প্রতি তার দরদ ছিল চোখে পড়ার মত। প্রধান শিক্ষকের স্নেহ মাখা প্রশ্রয় ও আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। সঙ্গে পেয়েছিলেন অধিকাংশ শিক্ষকের সহযোগিতা। সেখানে দীর্ঘ চোদ্দ বছর শিক্ষকতা করার পর প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন গলসী উচ্চ বিদ্যালয়ে। পুরনো বিদ্যালয় ছেড়ে আসার সময় ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকের চোখেও জল ঝড়তে থাকে। এখনো সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের প্রিয় শিক্ষককে ফোন করে। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি স্বাভাবিক দরদ, সহ-শিক্ষকদের প্রতি মমতা এবং মানুষের সঙ্গে মেশার ক্ষমতার জন্য গলসীতেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। চলে যেতে মন না চাইলেও পরিস্থিতি তাকে চলে যেতে বাধ্য করে। অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি বাড়ির কাছাকাছি রথতলা মনোহর দাস বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। প্রসঙ্গত বিনায়ক বাবুর বাবা সুশান্ত ব্যানার্জ্জী নিজেও একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক শিক্ষক বললেন, ‘যখন শুনলাম প্রধান শিক্ষক হিসাবে তিনি যোগ দিচ্ছেন মনের মধ্যে একটা চাপা ভয় ছিল। কিন্তু ওনার ব্যবহার অমায়িক । সবার সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কাজের স্বাধীনতা পাওয়া যায় ।’
অন্যদিকে বিনায়ক বাবু বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সন্তান তুল্য । তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য আছে। প্রধান শিক্ষক হিসাবে আমি সেই দায়িত্বটুকু পালন করেছি মাত্র ।’ তিনি আরও বলেন,’আমি প্রধান শিক্ষক হলেও সবার সহযোগিতাতেই একটা প্রতিষ্ঠান শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে । একটা সময় আমরা থাকব না, কিন্তু থাকবে প্রতিষ্ঠানটি । মানুষের স্মৃতিতে আমরা থাকব আমাদের কর্মের মাধ্যমে ।’।