আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজ যারা শিশু, কাল তারাই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ” প্রতিটি শিশু এই বার্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যে, স্রষ্টা এখনও মানুষের প্রতি আস্থা হারান নি”।
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ১৮ বছরের নীচে প্রতিটি মানুষই শিশু। সর্বসম্মতিক্রমে এই সংজ্ঞাটি গ্রহণ করা হয়েছে এবং শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে গৃহীত সনদে (The United Nations Convention on the Rights of the Child, বা UNCRC ) এ কথা বলা হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে এই সংজ্ঞাটি গ্রহণ করা হয়েছে এবং এই আন্তর্জাতিক আইনি অস্ত্রটি অধিকাংশ দেশই গ্রহণ করেছে ও অনুমোদন করেছে। ভারতবর্ষ বরাবরই ১৮ বছরের নীচের ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট আইনি অস্তিত্ব স্বীকার করে। এ কারণেই ১৮ বছর হলেই সেই ব্যক্তি ভোট দিতে পারে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পা বা আইনি চুক্তি করতে পারে। ১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ রোধ আইন অনুসারে ১৮ বছরের নীচে মেয়েদের এবং ২১ বছরের নীচে ছেলেদের বিয়ে আইনত সিদ্ধ নয়। তা ছাড়াও, ১৯৯২ সালের UNCRC সনদ অনুমোদনের পর, ১৮ বছরের নীচে যাদের যত্ন ও সুরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে তা যাতে তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পেতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে ভারত কিশোর অপরাধের বিচার সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন করেছে।
এক জন ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নির্ধারক বিষয় হল তার বয়স। যদি ১৮ বছরের নীচে কোনও ব্যক্তির বিবাহ হয় এবং সন্তান হয় তা হলেও আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে তাকে শিশু হিসেবেই গণ্য করা হবে। শিশু সুরক্ষা প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল কোনো ভেদাভেদ ছাড়া সমস্ত রকমের শিশুকে সুরক্ষা দেওয়া।
অধিকার ও সুরক্ষা
কি ?
১৯২৪ সালে লীগ অব নেশনস-এর ৫ম অধিবেশনে গৃহীত শিশু অধিকার ঘোষণায় শিশু অধিকারসমূহ প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক দলিলে স্থান পায়। ১৯৫৯ সালের শিশু অধিকার ঘোষণায় শিশুদের বহুবিধ সুবিধা, তাদের নিরাপত্তা ও অগ্রাধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। নতুন ঘোষণাপত্রের অধিকারসমূহ পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিনামায় পুনঃসমর্থিত এবং ১৯৬৬ সালে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়
সুরক্ষা বলতে বোঝায়, যে কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শিশুরা সব রকমের বঞ্চনা, নির্যাতন (শারীরিক ও মানসিক) লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা পাবে এবং তাদের প্রাথমিক অধিকারগুলি অর্জনের মাধ্যমে তাদের সামগ্রিক বিকাশ সাধনে সাহায্য করবে।
কিভাবে ?
বর্তমান আইন, পরিষেবা, ব্যবহার এবং কাজের ধারার মাধ্যমে।
কোথায় ?
শিশুদের পরিবার, বিদ্যালয়, কোনো প্রতিষ্ঠান, পুলিশি হেপাজত, সমাজ গোষ্ঠী সমস্ত জায়গায় যেখানে শিশুরা থাকে।
কাদের দ্বারা ?
সমস্ত রকম কর্তব্য পরায়ন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যেমন সরকার এবং সরকারী কর্মচারী, শিক্ষক, সমাজসেবী, পিতা-মাতা, শিশু প্রতিপালনকারী ব্যক্তি, নাগরিক, সমাজ, বিচারক, পুলিশ এবং শিশুদের নিজেদের দ্বারা ।
কখন ?
সবসময়ে অর্থাৎ সাধারণ সময়ে এবং জরুরী অবস্থায় ।
কেন ?
শিশুরা যাতে তাদের জীবন ধারণের অধিকার, সামগ্রিক বিকাশের অধিকার এবং নিরাপত্তার অধিকার অর্জনে সক্ষম হয়, যাতে শিশুর শৈশব বজায় থাকে।
শিশু সুরক্ষার বিষয় বস্তু
শিশু সুরক্ষা বলতে আমরা বুঝি কোনো শিশু লাঞ্ছনা, অবহেলা বা বঞ্চনার শিকার হবে না, প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকারগুলি যেমন যত্ন ও সুরক্ষা এবং ন্যায় বিচার সুরক্ষিত হবে এবং শিশুটি সামগ্রিকভাবে বিকাশ লাভ করবে। শিশুরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে যেমন :- শিশু লাঞ্ছনা, দেহ ব্যবসায়ে শিশুকে যুক্ত করা, শিশু পাচার, শিশু শ্রম এবং ক্ষতিকর কিছু গতানুগতিক প্রথা যেমন: কন্যা ভ্রাণ হত্যা, অপুষ্টি, পাচার, বাল্য বিবাহ ইত্যাদি। কিছু আপতকালীন পরিবেশে যেমন জরুরী অবস্থায়, যুদ্ধের সময়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এবং শারীরিকভাবে অক্ষম শিশুদের বিশেষ সুরক্ষার প্রয়োজনের কথা চিন্ত করে নির্দিষ্ট কর্মসূচী গ্রহণ করা।
ভারতবর্ষে শিশু সুরক্ষার প্রধান ক্ষেত্র
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে শিশু সুরক্ষার প্রধান ক্ষেত্রগুলি হল :
শিশুশ্রম
বাল্য বিবাহ
বিভিন্ন কারণে শিশু পাচার
অবহেলা এবং শিশু নির্যাতন-শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে এবং যৌন নিগ্ৰহ
যৌন হেনস্থা
পরিবারের যত্ন না পাওয়া শিশু যেমন – অনাথ এবং যারা প্রতিষ্ঠানে থাকে HIV/AIDS আক্রান্ত বা প্রভাবিত শিশুরা
আইনের সাথে সংঘাতে থাকা শিশুরা
কন্যা ভ্রূণ হত্যা
শারারীকভাবে অক্ষম শিশুরা
দুর্যোগ কবলিত শিশু
শিশুর অধিকারর গুলির ওপর রাষ্ট্রপুঞ্জের আধিবেশনে শিশুদের জন্য কি কি অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে।
শিশুর অধিকারর গুলিকে রাষ্ট্রপুঞ্জ চারটি মূল বিষয়ে ভাগ করেছে। এই চার ধরনের অধিকারগুলির প্রত্যেকটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ, সহজাত, সার্বজনীন, অবিচ্ছিন্ন, পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং একে অপরের সম্পূরক। এগুলি হল
শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার
শিশুর সুরক্ষা
শিশুর সামগ্রিক বিকাশের আধিকার
শিশুর অংশগ্রহণের আধিকার
ভারতীয় সংবিধান কিভাবে শিশু সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করে
ভারতীয় সংবিধানে শিশুদের জন্য কিছু অধিকার কয়েকটি নির্দিষ্ট ধারায় নথিবদ্ধ আছে, যেমন :
সাম্যের অধিকার (১৪নং ধারা)
বৈষম্যহীনতার অধিকার (১৫নং ধারা)
নারী এবং শিশুদের জন্য কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা তৈরী করা (১৫(৩)নং ধারা)
জীবন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার (২১নং ধারা)
৬-১৪ বছরের শিশুদের জন্য অবৈতনিক এবং আবশ্যিক শিক্ষার অধিকার (২১ক ধারা)
পাচার হওয়া থেকে এবং বলপূর্বক শিশু শ্রম থেকে সুরক্ষার অধিকার (২৩নং ধারা)
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার অধিকার (২৯নং ধারা)
১৪ বছর বয়সের আগে কোনো কারখানা, কয়লা খনি এবং যে কোনরকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হওয়া থেকে নিবৃতির অধিকার (২৪নং ধারা)
ভারতীয় সংবিধান নির্দেশাত্মক নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ওপরেও কিছু দায়িত্ব আরোপ করেছে যেমন
কর্মী, নারী, পুরুষ এবং শিশুদের স্বাস্থ্য এবং ক্ষমতার যাতে অপব্যবহার না হয় এবং দেশের কোনো নাগরিক যাতে তার আর্থিক সংস্থানের জন্য এমন কোনো পেশার সাথে যুক্ত না হয় যেটি তার বয়স এবং শারীরিক দক্ষতার সাথে মানানসই নয় সেটি সুনিশ্চিত করা (৩৯(ঙ) নং ধারা)।
শিশুরা যাতে একটি সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, স্বাধীনভাবে, মর্যাদার সাথে বেড়ে ওঠার সকল রকম সুযোগ এবং সুবিধা পায় এবং শৈশব এবং কৈশোর যাতে সবরকমের অপব্যবহার এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে সুরক্ষিত থাকে (৩৯(চ)নং ধারা)। রাষ্ট্র প্রাক-শৈশব যত্ন এবং ৬ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সব শিশুর শিক্ষাকে নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা করবে (৪৫নং ধরা)
পিছিয়ে পড়া এবং দুর্বল শ্রেণীগুলির জন্য বিশেষভাবে শিক্ষা এবং আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা চালু করতে, বিশেষত তফশিলি জাতি ও উপজাতি এবং এদের সকলরকমের সামাজিক অন্যায় এবং অপব্যবহার থেকে সুরক্ষিত করতে হবে (৪৬নং ধারা)।
জনগণের জীবনযাত্রার মান এবং পুষ্টির মানকে উন্নত করা এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করা। বিশে একমাত্র ঔষধ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর মাদক পানীয় এবং দ্রব্যের ব্যবহার নি করার জন্য চেষ্টা করবে (৪৭নং ধারা)।
শিশু সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করার নির্দিষ্ট আইন
নিম্নলিখিত আইনগুলি শিশু সুরক্ষার সাথে সম্পকিত —
গর্ভবধারণের আগে এবং জন্মের আগে ভ্রণ নির্ণায়ক কৌশলসমূহের (লিঙ্গ নির্ধারণের নিবারণ) আইন, ১৯৯৪ (Pre-Conception and Pre-Natal Diagnostic Techniques (Prohibition of Sex Selection) Act 1994)
বাল্য বিবাহ নিবারন আইন, ২০০৬ (Child Marriage Prohibition Act, 2006)
শিশু শ্রমিক (নিবারন ও নিয়ন্ত্রন) আইন, ১৯৮৬ (Child Labour (Prohibition and Regulation Act – 1986)
অর্থনৈতিক পাচার প্রতিরোধ আইন , ১৯৫৬ (Immoral Traffic Prevention Act 1956)
অক্ষমতা প্রতিরোধকারী (সমান সুযোগ প্রদানকারী, অধিকার সুরক্ষা ও পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ সুনিশ্চিতকারী) আইন (Persons with Disabilities (Equal Opportunities, Protection of Rights and Full Participation) Act, 1995)
কিশোর ন্যায় বিচার (শিশুদের যত্ন ও সুরক্ষা) আইন ২০০০ এবং আইনি সংশোধন, ২০০৬ (Juvenile Justice (Care & Protection of Children) Act, 2000 and its Amendment, 2006)
শিশুর অধিকারগুলির জন্য শিশু সুরক্ষা কমিশন আইন, ২০০৫ (Commission for Protection of Child Rights Act, 2005)
শিশুদের বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯ (Right of Children to Free and Compulsory Education Act, 2009)
যৌন নিগ্রহ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইন (Protection of Children from Sexual Offences Act, 2012)
উপরিল্লিখিত আইনগুলির প্রণয়নের জন্য রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই নির্দেশাবলী (Rules) তৈরী করেছেন। এগুলি ছাড়াও অতিরিক্ত এমন অসংখ্য ধারা ভারতীয় দন্ডবিধিতে আছে যেগুলি শিশু সুরক্ষা সুনিশ্চিত করে এবং যারা শিশুর সুরক্ষার অধিকারকে লঙ্ঘন করে তাদের যথাযথ শাস্তি প্রদানে সহায়তা করে।
বর্তমানে শিশুসুরক্ষার জন্য প্রকল্প চালু আছে
পশ্চিমবঙ্গে যে শিশু সুরক্ষা সম্পর্কিত প্রকল্পগুলি চালু আছে সেগুলি হল :
কিশোর ন্যায় বিচার বিষয়েক একটি কর্মসূচী (Programme for Juvenile Justice)
পথ শিশুদের জন্য একটি সুসংহত কর্মসূচী (Integrated Programme for Street Children)
শিশু গৃহ কর্মপরিকল্পনা ও দত্তক গ্রহণ সক্রান্ত কর্মসূচি (Sishu Griha Scheme and Adoption)
অন্যায়, অবহেলিত, দুর্যোগ কবলিত, বঞ্চনার শিকার, মানসিক ভারসাম্যহীন শিশুদের জন্য আবাস (Home for children victims of exploitation, neglect, disaster and mentally challenged)
আইনের জন্য সংঘাতে লিপ্ত শিশুদের জন্য আবাস (Programme for Juvenile Justice)
ন্যায় বিচার প্রদানে বিধিবদ্ধ সংস্থা (Juvenile Justice Board)
অনাথ ও দুঃস্থ শিশুদের জন্য আবাস (Cottage Home)
এছাড়া যে অন্য প্রকল্পগুলি চালু আছে সেগুলি হল :
যৌনকর্মীদের সন্তানদের শিক্ষা ও সুরক্ষা প্রদান কর্মসূচী
কর্মরতা ও অসুস্থ মায়েদের শিশুদের (০-৫ বছর) রক্ষণের জন্য ক্রেশ প্রকল্প
জাতীয় শিশু শ্রমিক বিদ্যালয় (কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের পরিচালনাধীন)
সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের আয়ত্তাধীন যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প
মানুষ পাচার রোধের জন্য এবং পাচারের শিকার শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য উজালা প্রকল্প
** সুত্র : Google ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিশু বিকাশ দফতর