এইদিন ওয়েবডেস্ক,ঢাকা,২২ জানুয়ারী : বাংলাদেশের অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমুর হত্যাকাণ্ডে ধৃত মৃতার স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম ও তাঁর বন্ধু এসএমওয়াই আবদুল্লাহ ফরহাদকে জেরা করে খুনের দিন ঠিক কি ঘটেছিল তা জানতে পেরেছে পুলিশ । গত ২০ জানুয়ারি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম সাইফুল ইসলামের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন শিমুর স্বামী শাখাওয়াত । অপর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিশকাত শুকরানার কাছে জবানবন্দি দেন ফরহাদ । ধৃত দু’জনেই এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে নিজেদের জড়িত থাকার কথা কবুল করেছেন । তাঁরা স্বীকার করেছেন, গত ১৬ জানুয়ারী সকালে রাইমা ইসলাম শিমু ও তাঁর স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম যখন ঝগড়া করছিলেন সেই সময় তাঁদের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন এস এম ওয়াই আবদুল্লাহ ফরহাদ । বন্ধুর কথামত শিমুর গলা টিপে ধরেন ফরহাদ । এরপর শিমু মাটিতে পড়ে গেলে তাঁর গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শাখাওয়াত । শিমুর মৃত্যু নিশ্চিত জানার পর দু’জন মিলে লাশ পাচারের ষড়যন্ত্র করে ।
ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ দক্ষিণ) হুমায়ুন কবির কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন,ঘটনার দিন টাকা চাইতে শাখাওয়াতের গ্রিন রোডের বাড়িতে গিয়েছিলেন ফরহাদ । শিমু দরজা খুলে দেন। ড্রয়িংরুমে ফরহাদকে বসতে বলে শাখাওয়াতকে ডেকে দেন শিমু । তারপর শিমু তাঁর স্মার্টফোন নিয়ে কিছু একটা করছিলেন । তখন শিমুকে উদ্দেশ্য করে শাখাওয়াত হঠাৎ বলেন, ‘তুমি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারতে, আমরা চা খাব কি না । জিজ্ঞেস না করে তুমি মোবাইলে কী করছ ?’
এরপর শিমুর হাত থেকে ফোন কেড়ে নেন শাখাওয়াত । এ থেকেই দু’জনের মধ্যে ঝগড়ার শুরু । বচসার নাঝে একপর্যায়ে দুজনে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায় । চিৎকার শুনে ফরহাদ তাঁদের শোয়ার ঘরে ঢোকেন। এ সময় শিমুর গলা চেপে ধরেন শাখাওয়াত । তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন শিমু। দু’জনেই একে অন্যকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকেন । এরপর শিমুর গলা টিপে ধরতে ফরহাদকে ডাকেন শাখাওয়াত । ফরহাদ এসে শিমুর গলা টিপে ধরেন। ধস্তাধস্তিতে শিমু মাটিতে পড়ে যান । ফরহাদ আদালতের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, শিমু মাটিতে পড়ে গেলে শাখাওয়াত তাঁর গলার ওপর পা দিয়ে দাঁড়ান। কিছুক্ষণ পর তাঁরা বুঝতে পারেন শিমু মারা গেছেন । এরপর দু’জনে মিলে লাশ পাচারের পরিকল্পনা শুরু করেন ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির জানান, এরপর শিমুর হাত ধরেন শাখাওয়াত । ফরহাদকেও শিমুর হৃৎস্পন্দন পরখ করতে বলেন । তিনি নাকের নিচে হাত দিয়ে বুঝতে পারেন, শিমুর শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ । শিমু মারা গেছেন নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁর লাশ চটের বস্তায় ভরেন শাখাওয়াত ও ফরহাদ । শাখাওয়াত নিজেই একটি প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে বস্তা সেলাই করেন । ইতিমধ্যে বাড়িতে পরিচারিকা কাজে চলে আসে । শাখাওয়াত তাঁকে চলে যেতে বলেন ।
পরিচারিকা চলে যেতেই সিঁড়ি দিয়ে শিমুর লাশভর্তি বস্তা নামানোর সময় হঠাৎ এই দুই বন্ধু মনে হয় সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন । সেটি বিচ্ছিন্ন করে আবার তাঁরা নামতে শুরু করেন । সেই সময় বাড়ির নিচে দায়িত্ব পালন করছিলেন দুই নিরাপত্তারক্ষী জামাল ও আরিফ । তাঁদের কায়দা করে সরিয়ে দেয় শাখাওয়াত । এরপর দুই বন্ধু মিলে শিমুর লাশ গাড়িতে তোলেন । শাখাওয়াত তার বন্ধু ফরহাদকে শিমুর স্মার্টফোন গ্রিন রোডের টাওয়ারের বাইরে গিয়ে বন্ধ করে আসতে বলেন । বন্ধুর কথামত ফরহাদ আজিমপুর গিয়ে শিমুর স্মার্টফোনটি বন্ধ করে আবারও গ্রিন রোডে ফিরে আসেন ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানিয়েছে, ধৃতরা কবুল করেছে যে তাঁরা লাশ গুম করতে প্রথমে মিরপুরের দিকে যান । কিন্তু মিরপুরের নানা জায়গা ঘুরে কোথাও তাঁরা লাশটি ফেলতে পারেননি । তাই দুপুরের পর ফের তারা বাড়িতে ফিরে আসেন । ঘরে না ঢুকে অপেক্ষা করতে থাকেন নিচেই । তখনও শিমুর লাশ গাড়িতে বস্তাবন্দি অবস্থায় রয়েছে । এরপর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শাখাওয়াতকে তাঁর মেয়ে ফোন করে । সে জানায় মায়ের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে শিমুর বোনও ফোন করেন । তিনিও জানান শিমুর ফোন বন্ধ । এর কিছু পরেই ধানমন্ডির ভেতর দিয়ে মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে নির্জন জায়গা দেখে দুই বন্ধু শিমুর বস্তাবন্দি দেহ ফেলে দিয়ে আসে । লাশ ফেলে ঢাকায় ফেরার পথে প্রথমে শিমুর ভ্যানিটি ব্যাগ ছুড়ে ফেলেন তাঁরা । আরও পরে শিমুর মুঠোফোন জলে ফেলেন ।
জবানবন্দিতে শাখাওয়াত জানিয়েছেন, ভালোবেসে তিনি শিমুকে বিয়ে করেছিলেন । দুই সন্তান নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার । স্ত্রী তাঁর সম্মতি নিয়েই অভিনয়ে যুক্ত হয়েছিলেন । সম্প্রতি একটি বেসরকারি চ্যানেলে চাকরি নিয়েছিলেন শিমু । ইদানীং স্ত্রীকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন শাখাওয়াত । তা থেকেই মনোমালিন্যের শুরু ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দীন কবির বলেন,হত্যাকাণ্ডের সময় শিমু ও শাখাওয়াত দম্পতির ছেলে-মেয়ে বাড়িতেই ছিল । রাইমার মেয়ে অনেক রাত অবধি পড়ালেখা করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাবা-মা ঝগড়া করলেও সে মাথা ঘামায়নি । ভেবেছিল অনান্য দিনের মতই আবার মিটমাটও হয়ে যাবে । কিন্তু বাবা ও বাবার বন্ধু মিলে যে তাদের মাকে নৃসংসভাবে খুনের চক্রান্ত করেছে তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি । শিমুর দুই সন্তান বাবা-মায়ের ঝগড়ার মাঝে এসে পড়লে হয়তো তাঁর এই মর্মান্তিক পরিনতি হত না বলে মনে করছে প্রতিবেশীরা ।।