জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গুসকরা(পূর্ব বর্ধমান),০৭ জানুয়ারী : ওরা তিনজন – অর্পিতা রায়, সুপ্রিয়া চক্রবর্তী ও মণিপুষ্পক খান। স্কুল জীবনের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। মেরেকেটে বয়স ১৬-১৭ বছর। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা সাধারণত আনন্দে মেতে উঠতে ভালবাসে। অথচ এই অল্প বয়সেই ওরা সমাজের প্রতি নিজেদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে চলেছে। ওরা ২০২২ সালের উচ্চমাধ্যমিকের ক্যাণ্ডিডেট। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভাল। আগামী এপ্রিল মাসে ওদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। নিজেদের পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে ওরা নেমে পড়েছে মানুষ গড়ার কাজে ।
উদ্যোগ বা পরিকল্পনাটা মণিপুষ্পকের । করোনা অতিমারিতে গত প্রায় দু’বছর ধরে পড়াশোনা কার্যত বন্ধ। অনলাইনে পড়াশোনা শুরু হলেও গরীব আদিবাসী ঘরের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কারণ এই সিস্টেমে পড়াশোনার জন্য দরকার একটা হাজার দশেক টাকার স্মার্টফোন এবং মাসে মাসে মহামূল্য রিচার্জ। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে তাদের মা-বাবারা নিজের সন্তানদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে দামি স্মার্টফোন কিনে দেওয়াটা চরম বিলাসিতা । সন্তানদের স্বার্থে ধারদেনা করে যদিও বা ফোন কিনে দেওয়া যায় কিন্তু মাসে রিচার্জের খরচ কে দেবে? অর্থাৎ ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত ।
ফলে বাড়তি আয়ের জন্য মা-বাবার সঙ্গে কেউ যাচ্ছে মাঠে, কেউ বা পড়াশোনা থেকে দূরে সরে খেলায় মত্ত হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নজরে পড়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের ছাত্র মণিপুষ্পকের। সে গুসকরা পুর এলাকার ৬ নং ওয়ার্ডের শান্তিপুরের বাসিন্দা। সে লক্ষ্য করে দেখে ১৪ নং ওয়ার্ডের আদিবাসী ছেলেমেয়েরা কার্যত পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ওদের জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবে সে। নিজের ভাবনাটা প্রকাশ করে দুই বান্ধবী সুপ্রিয়া ও অর্পিতাকে। প্রথম জনের বাড়ি ১৪ নং ওয়ার্ডের আলুটিয়ায় এবং অপরজনের বাড়ি ভাতার থানার দেবপুরে। অপর দু’জনের মনেও ছিল একই ভাবনা। সিদ্ধান্ত হয় সপ্তাহে অন্তত দু’দিন তারা সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের বাচ্চাদের পড়াবে ।
শুধু ভাবলেই হবেনা, দরকার স্হানীয় সহযোগিতা। এই উদ্দেশ্যে মণিপুষ্পক যোগাযোগ করে স্হানীয় তৃণমূল নেত্রী সাধনা কোনারের সঙ্গে । বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের পরিকল্পনা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ছেলেটিকে পড়াশোনা করা আদিবাসীদের বাড়ি বাড়ি নিয়ে যান তিনি। প্রথমে রাজী নাহলেও পরে অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠাতে রাজী হয়। সবার সহযোগিতায় জুটে যায় চেয়ার টেবিল এবং গত ৩ রা জানুয়ারি থেকে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে পাঠদান শুরু হয়। ঠিক হয়েছে আপাতত বৃহস্পতি ও শনিবার এই দু’দিন বিকেল তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত একঘণ্টার জন্য পাঠদান করা হবে ।
এইভাবে পড়ানোর ব্যাপারটা খুব একটা সহজ ছিলনা। সামনেই নিজেদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। স্বাভাবিক ভাবেই পরিবারের চাপ তো ছিলই। মা-বাবাকে বোঝানোর পর তারা আর বাধা দেননি। উল্টে ছেলেমেয়েগুলোর মহতী কাজের প্রশংসা করে গেছেন ।
সুপ্রিয়ার বাবা অমলেন্দু চক্রবর্তী একজন সামান্য ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘অভিভাবক হিসাবে আমি বা আমরা চাইব আমাদের ছেলমেয়েরা নিজেদের পড়াশোনার দিকে নজর দিক। সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। যখন দেখলাম নিজেদের পড়াশোনার ক্ষতি না করে ওরা সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে তখন বুকটা গর্বে ভরে গেল। সুপ্রিয়ার মত মণিপুষ্পক ও অর্পিতাও আমার সন্তান ।
মূলত যার উদ্যোগে এই মহতী কাজটা শুরু হয়েছে সেই মণিপুষ্পক বলল- আমি মনে করিনা বিশাল কোনো মহতী কাজ করেছি। ওরা আমাদের ভাই-বোন। ওদের পড়াশোনায় সাহায্য করাটা নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছি। একই সুর শোনা গেল অর্পিতা ও সুপ্রিয়ার কণ্ঠে। দুজনেরই বক্তব্য, ‘পরীক্ষার পর ওদের জন্য আরও বেশি সময় দেওয়ার চেষ্টা করব ।’
অন্যদিকে সাধনা কোনার বলেন,’মণিপুষ্পক আমাকে তার পরিকল্পনার কথা বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে ওদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। তার কাছেই জানা গেল তার ওয়ার্ডের অন্যান্য আদিবাসী অভিভাবকরাও নিজেদের সন্তানের পড়াশোনার সাহায্যের জন্য এসেছে। এটা খুবই ভাল লক্ষণ ।
ছেলেমেয়ে তিনটির প্রচেষ্টার কথা শুনে শহর সভাপতি তথা পৌর প্রশাসক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য কুশল মুখার্জ্জী বললেন – এটা খুবই গর্বের ব্যাপার। আমাদের বিধায়কের সঙ্গে আলোচনা করে দেখি দলের বা পুরসভার পক্ষ থেকে পড়ানোর জায়গাটার মাথার উপর কোনো ছাউনির ব্যবস্থা করা যায় কিনা ।।