শ্রীমদভগবদগীতা হল এমনই একটি পবিত্র ধর্মপুস্তক যা জ্ঞানী বন্ধুর মতো আমাদের পথ দেখায়। এটি জীবন, আমাদের কী করা উচিত এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে চিরন্তন জ্ঞানে পরিপূর্ণ। এর পাতাগুলি ঘুরে দেখার সাথে সাথে আমরা এমন কিছু আশ্চর্যজনক উক্তি আবিষ্কার করব যা যুগ যুগ ধরে হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আমরা ভগবদ গীতা থেকে এমন পাঁচটি বিখ্যাত উক্তির কথা বলবো, যা অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে যা আমাদের নিজেদেরকে আরও ভালভাবে বুঝতে এবং পৃথিবীতে আমাদের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারে।
ভগবদ গীতার উক্তি
ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৪৭
“কর্ম্মণে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচনা,
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সংগোস্ত্বকর্মাণি”
“তোমার নির্ধারিত কর্তব্য পালনের অধিকার তোমার আছে, কিন্তু তোমার কর্মের ফলের অধিকার তোমার নেই। নিজেকে কখনো তোমার কর্মের ফলাফলের কারণ মনে করো না, অথবা নিষ্ক্রিয়তার প্রতি আসক্ত হও না।”
ব্যাখ্যা: এই শ্লোকটি আমাদের ফলাফল নিয়ে খুব বেশি চিন্তা না করে আমাদের কর্তব্য পালনের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। এটি আমাদের বলে যে আমাদের যা করা দরকার তা করার উপর আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত, তবে ফলস্বরূপ যা ঘটে তার প্রতি আমাদের খুব বেশি আসক্ত হওয়া উচিত নয়।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ: কল্পনা করুন আপনার স্কুলে একটি বড় পরীক্ষা আসছে। আপনার কর্তব্য হল কঠোর পরিশ্রম করা এবং যথাসাধ্য প্রস্তুতি নেওয়া। তাই, আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াশোনা এবং আপনার সেরা প্রচেষ্টায় ব্যয় করেন। কিন্তু, যখন পরীক্ষার দিন আসে, তখন আপনি দেখতে পান যে প্রশ্নগুলি সত্যিই কঠিন, এবং আপনি যতটা আশা করেছিলেন ততটা ভালো করেন না।
এখন, এই শ্লোক অনুসারে, যদিও আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাননি, তবুও আপনার প্রচেষ্টা এবং কঠোর অধ্যয়নের মাধ্যমে আপনার কর্তব্য পালনের জন্য নিজেকে নিয়ে গর্বিত বোধ করা উচিত। শ্লোকটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে আমরা যা কিছু করি তাতে আমাদের সেরাটা দেওয়ার উপর মনোনিবেশ করা উচিত, তবে আমাদের খুব বেশি চিন্তা করা উচিত নয় যে সবকিছু ঠিক যেমনটি আমরা আশা করেছিলাম তেমনই হবে কিনা। পরিবর্তে, আমাদের নিষ্ঠার সাথে এবং ফলাফলের প্রতি খুব বেশি আসক্ত না হয়ে আমাদের কর্তব্য পালনের উপর মনোনিবেশ করা উচিত।
ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৪৮
“योगस्थः कुरु कर्माणि संङ्गां त्यक्त्वा धनंजय।
सिद्ध्यसिद्ध्योः समो भूतं समत्वं योग उच्यते ॥”
“হে অর্জুন, সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রতি সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে, সমতাপূর্ণভাবে তোমার কর্তব্য সম্পাদন করো। এই ধরনের সমতাকে যোগ বলা হয়।”
ব্যাখ্যা: এই শ্লোকটি অর্জুনকে (এবং আমাদের) পরামর্শ দেয় যে আমরা সফল হই বা ব্যর্থ হই, তাতে খুব বেশি আসক্ত না হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ মন নিয়ে আমাদের কর্তব্য পালন করাই উচিত । এটি আমাদের শেখায় যে ফলাফল যাই হোক না কেন, অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং ভারসাম্য বজায় রাখাই হল প্রকৃত যোগ (ঐশ্বরিক মিলন)।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ: কল্পনা করুন আপনি একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ধরুন একটি বাস্কেটবল খেলার জন্য। একজন খেলোয়াড় হিসেবে আপনার কর্তব্য হল কঠোর অনুশীলন করা, খেলার সময় আপনার সেরাটা খেলা এবং আপনার দলের সাফল্যে অবদান রাখা। তবে, খেলার সময় উত্থান-পতন ঘটে। কখনও কখনও আপনার দল পয়েন্ট অর্জন করে, এবং কখনও কখনও প্রতিপক্ষ দল করে। শেষ পর্যন্ত, আপনার দল জিতুক বা হারুক, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আপনি ফলাফলের সাথে অতিরিক্ত সংযুক্ত না হয়ে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী আপনার ভূমিকা পালন করা ।
এই উদাহরণে, ভারসাম্যের সাথে আপনার কর্তব্য পালন করার অর্থ হল আপনার দল জিতুক বা হারুক না কেন, শান্ত এবং সংযত থাকার সময় মাঠে আপনার সর্বোত্তম প্রচেষ্টা করা। এটি বাহ্যিক পরিস্থিতি নির্বিশেষে, আপনি আপনার ভূমিকা পালন করেছেন তা জেনে অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং সন্তুষ্টি খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে। এই পদটি আমাদের জীবনের চ্যালেঞ্জগুলিকে ভারসাম্যপূর্ণ মানসিকতার সাথে মোকাবেলা করতে শেখায়, ফলাফলে আটকে না থেকে আমাদের কর্মের উপর মনোযোগ দিতে শেখায় ।
ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ৪, শ্লোক ৭
“यदा यदा हि धर्मस्य ग्लानिर्भवति भारत।
अभ्युत्थानमधर्मस्य तदात्मानं सृजाम् यहम् ॥”
“যখন এবং যেখানেই ধর্মচর্চার অবনতি ঘটে, হে ভরতের বংশধর, এবং ধর্মের প্রবল উত্থান ঘটে – সেই সময় আমি নিজেই অবতরণ করি।”
ব্যাখ্যা: এই শ্লোকে, কৃষ্ণ, যিনি অর্জুনের সাথে কথা বলছেন, ব্যাখ্যা করেছেন যে যখনই পৃথিবীতে ধার্মিকতার পতন হয় এবং অন্যায় বা “অধর্ম” বৃদ্ধি পায়, তখনই তিনি ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করতে এবং যা সঠিক তা সমুন্নত রাখার জন্য আআত্মপ্রকাশ করেন।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ: এমন একটি পাড়া কল্পনা করুন যেখানে লোকেরা একে অপরকে সাহায্য করত, তাদের প্রবীণদের সম্মান করত এবং শান্তিতে বসবাস করত। তবে, সময়ের সাথে সাথে, লোকেরা স্বার্থপর, অসম্মানজনক এবং ক্ষতিকারক আচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে, কেউ হয়তো সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে দয়া, শ্রদ্ধা এবং সম্প্রীতি বৃদ্ধির জন্য এগিয়ে আসতে পারে। এই ব্যক্তি আলোর বাতিঘর হিসেবে কাজ করে, অন্যদের ধার্মিকতা এবং নৈতিক মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত করে।
এই উদাহরণে, যে ব্যক্তি পাড়ায় সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসে তাকে ঐশ্বরিক গুণাবলীর প্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা শ্লোকে উল্লিখিত কৃষ্ণের বংশধরের মতো। তারা ধার্মিকতার নীতিগুলিকে মূর্ত করে এবং প্রচলিত নেতিবাচক প্রবণতাগুলিকে প্রতিহত করার জন্য প্রচেষ্টা করে, ঠিক যেমন কৃষ্ণ ধর্ম (ধার্মিকতা) পুনরুদ্ধারের জন্য অবতরণ করেন যখনই এটি হুমকির সম্মুখীন হয়।
ভগবদ্গীতা, অধ্যায় ৫, শ্লোক ১৮
“विद्याविनयसम्पने ब्राह्मणे गवि हस्तिनि।
शुनि चैव श्वपाके च पण्डिताः समदर्शिनः॥”
“নিম্র ঋষিগণ, সত্য জ্ঞানের গুণে, একজন বিদগ্ধ ও ভদ্র ব্রাহ্মণ, একটি গরু, একটি হাতি, একটি কুকুর এবং একটি কুকুর ভক্ষক [বহির্ভূত]কে সমান দৃষ্টিতে দেখেন।”
ব্যাখ্যা: এই শ্লোকে, কৃষ্ণ প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী আলোকিত ব্যক্তিদের মানসিকতার বর্ণনা দিয়েছেন। তারা সকল জীবকে, তাদের সামাজিক অবস্থান বা প্রজাতি নির্বিশেষে, সমান শ্রদ্ধা এবং করুণার সাথে দেখেন। এই ধরনের আলোকিত ব্যক্তিরা সমস্ত জীবনের অন্তর্নিহিত মূল্য এবং আন্তঃসম্পর্ককে স্বীকৃতি দেন।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ: কল্পনা করুন আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, এবং আপনি বিভিন্ন মানুষ এবং প্রাণীর মুখোমুখি হন। আপনি একজন সুশিক্ষিত অধ্যাপক, একজন নম্র পরিচারক, একজন রাস্তার বিক্রেতা, একটি পথভ্রষ্ট কুকুর এবং একটি প্রান্তিক সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তিকে দেখতে পান। এখন, বিবেচনা করুন আপনি তাদের প্রত্যেককে কীভাবে দেখেন এবং তাদের সাথে কীভাবে আচরণ করেন।
শ্লোকে বর্ণিত একজন আলোকিত ব্যক্তি এই সকল প্রাণীর সাথে সমান দয়া, শ্রদ্ধা এবং করুণার সাথে আচরণ করবেন, প্রত্যেকের অন্তর্নিহিত মূল্য এবং মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেবেন। তারা কেবল মানুষই নয়, প্রাণীদের প্রতিও তাদের যত্ন প্রসারিত করবেন, বুঝতে পারবেন যে সমস্ত জীবই ভালোবাসা এবং বিবেচনার যোগ্য।
এই উদাহরণে, আলোকিত ব্যক্তির ভাসাভাসা পার্থক্যের বাইরে দেখার এবং প্রতিটি সত্তার সারাংশ উপলব্ধি করার ক্ষমতা শ্লোকে তুলে ধরা গভীর জ্ঞানকে প্রতিফলিত করে। তারা বিশ্বকে সমান দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে, পক্ষপাত বা বৈষম্যমুক্ত, করুণা এবং অন্তর্ভুক্তির আদর্শকে মূর্ত করে।
ভগবদ্গীতা, ১৮ অধ্যায়, শ্লোক ৬৬
“सर्वधर्मान्परित्यज्य मामेकं शरण व्रज।
अहं त्व सर्वपापेभ्यो मोक्षयिष्यामि मा शुचः॥”
“সকল প্রকার ধর্ম বর্জন কর এবং শুধু আমার কাছে আত্মসমর্পণ কর। আমি তোমাকে সমস্ত পাপের প্রতিক্রিয়া থেকে উদ্ধার করব। ভয় পেয়ো না।”
ব্যাখ্যা: এই শ্লোকে, কৃষ্ণ অর্জুনকে অন্যান্য সকল ধর্মীয় রীতিনীতি ত্যাগ করে সম্পূর্ণরূপে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে তার কর্মের (পাপমূলক প্রতিক্রিয়া) পরিণতি থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তাকে ভয় না পাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ: কল্পনা করুন আপনি একটি যাত্রায় আছেন, এবং আপনি এমন একজন গাইডের সাথে দেখা করেন যিনি পথটি ভালোভাবে জানেন। আপনি আপনার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন পথ এবং পদ্ধতি চেষ্টা করছেন, কিন্তু কিছুই কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। গাইড আপনাকে তার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে এবং তার নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে বলে। তিনি আপনাকে নিরাপদে আপনার গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং আপনাকে আশ্বস্ত করেন যে চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।
এই উদাহরণে, পথপ্রদর্শক কৃষ্ণের প্রতিনিধিত্ব করেন, এবং যাত্রা জীবনের চ্যালেঞ্জ এবং সংগ্রামের প্রতীক। পথপ্রদর্শক যেমন সফল যাত্রার জন্য তাঁর কাছে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেন, তেমনি কৃষ্ণ অর্জুনকে জীবনের যাত্রায় নির্দেশনা এবং সুরক্ষার জন্য তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দেন। কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণের অর্থ জীবনের বাধাগুলি অতিক্রম করে পরিণামে আধ্যাত্মিক মুক্তি অর্জনের জন্য তাঁর জ্ঞান এবং ঐশ্বরিক নির্দেশনার উপর আস্থা রাখা।।