এইদিন ওয়েবডেস্ক,কাবুল,১২ মার্চ : আজ থেকে ঠিক ২২ বছর আগে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তালিবানের জঙ্গি মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের নির্দেশে ধ্বংস করা হয়েছিল বামিয়ানে সুপ্রাচীন দুটি বিশালাকার বুদ্ধ মূর্তি । তালিবানরা কামান-ট্যাঙ্ক-রকেট-মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়েও বুদ্ধের মূর্তি দুটি ধ্বংস করতে পারেনি । শেষে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয় দেখিয়ে মূর্তি দুটি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয় ওই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি । ভাঙতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েক দিন । পাহাড়ের মাঝে খোদাই করে যেখানে মূর্তি দুটি রাখা ছিল, বর্তমানে সেখানে দুটি বিশাল আকৃতির গর্ত রয়ে গেছে । তারপর গত দুই দশকে পূর্ববর্তী সরকারগুলো এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে পুনরুদ্ধার করার কোনো চেষ্টাই করেনি । আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের সালসাল ও শাহমামার এলাকার দুই সুপ্রাচীন বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করে “শতাব্দীর সাংস্কৃতিক হত্যাকারী” খেতাব পাওয়া তালিবান আজ দেশের ক্ষমতায় রয়েছে ।
আফগানিস্তানের এক সংবাদ মাধ্যম এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যিনি বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংসের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বছর ৬০- এর ওই বৃদ্ধ ঘটনার বিবরণে বলেছেন,তালিবান ১৫ দিন ধরে বুদ্ধ মূর্তির কিছু অংশে বিস্ফোরক লাগাতে তাদের বাধ্য করেছিল । তবে তিনি ও তার সহকর্মীরা জানতেন না কেন তালিবানরা এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিতে তাদের দিয়ে বিস্ফোরক উপকরণগুলি লাগানো করাচ্ছে ।
বামিয়ানের বাসিন্দা ওই বৃদ্ধ বলেন,প্রায় ২২ বছর আগে আমি নিজের চোখে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস দেখেছিলাম । সালসাল ও শাহমামার প্রাচীন মূর্তির দেহে বিস্ফোরক দ্রব্য স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আমারও ভূমিকা ছিল । মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের বুদ্ধ মূর্তিগুলি ধ্বংসের আদেশের পরে সেই সময় বামিয়ানের স্থানীয় তালিবান কর্মকর্তারা তাদের জঙ্গিদের হাতে সালসাল বিশাল মূর্তিটি ধ্বংস করার প্রক্রিয়া ছেড়ে দিয়েছিল । তার মতে, ওই জঙ্গিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি ও আরব নাগরিকও ছিল । জঙ্গিরা প্রায় এক মাস ধরে ভারী অস্ত্র যেমন মর্টার, রকেট, ট্যাঙ্ক ইত্যাদি ব্যবহার করেছিল । কিন্তু তারা মূর্তিগুলি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
বৃদ্ধ বলেন,’তালিবানরা প্রতিদিন সকালে ৫০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং বেশিরভাগ যুদ্ধবন্দী এবং বন্দীকে বলপ্রয়োগ করে এবং মৃত্যুর হুমকি দেখিয়ে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করার জন্য নিয়ে যেত । আমরা যখন বুদ্ধের কাছে পৌঁছলাম, তারা আমাদের কোমরে দড়ি বেঁধে মূর্তির ওপরের গিরিপথ থেকে বুদ্ধের কাঁধে ও শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে নামতে বাধ্য করল । তালিবান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আমরা তা করতে বাধ্য হই । এই কাজটি করতে আমাদের প্রায় ১৫ দিন সময় লেগেছিল ।’
তিনি দুঃখের সাথে বলেন,’১৫ তম দিনে আমি এবং আমার সঙ্গীরা ওই কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যখন আমরা সালসালের মূর্তির পিছন দিয়ে নামছিলাম তখন একটি ভয়ানক শব্দ শুনতে পাই । বিকট আওয়াজে আমি মাটিতে পড়ে যাই । কারণ জানতে আমি বুদ্ধের সামনে আসি। দেখি মাটির তৈরি ৫৩ মিটারের মূর্তিটি বিস্ফোরিত হয়েছে । সেই সময় সেখানে বেশ কিছু আরব এবং পাকিস্তানি জঙ্গিও উপস্থিত ছিল । তারা “আল্লাহু আকবর” স্লোগান দিয়ে একে অপরকে অভিনন্দন জানায়।’ বৃদ্ধ জানান,বামিয়ান উপত্যকার পূর্বে কেকরাক উপত্যকায় শাহমামায় অবস্থিত ৩৫ মিটারের এবং বাতবাচেহের ৭ মিটার মূর্তি ধ্বংস করতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল,কিন্তু সালসাল ৫৩ মিটারের মূর্তিটি ধ্বংস হতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগেছিল । তার মতে, এই কাজের জন্য তালিবান জঙ্গিরা প্রায় এক মাস ধরে বেসামরিক নাগরিকদের ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ডক্টর লায়েক আহমাদী 8সোবাহ পত্রিকাকে এই বিষয়ে বলেছেন,’আফগানিস্তানকে অনৈসলামিক ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে মুক্ত করা এবং অনৈসলামিক শিল্প ও সংস্কৃতি পরিষ্কার করার অসংখ্য নজির আছে আফগানিস্তানে । আওরঙ্গজেব, আমির আবদুল রহমান খান এবং আমির হাবিবুল্লাহ খান সহ দেশের পূর্ববর্তী শাসকদের সময় থেকে দেশে এমন ঘটনা ঘটে আসছে ।’ তালিবান দ্বারা বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংসের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,এটি একটি সাংস্কৃতিক অনুকরণ কৌশল । কারণ এই শাসকরা অনৈসলামিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ধ্বংস করে একটি সম্পূর্ণ ইসলামী ভূখণ্ডের উত্তরাধিকারী হওয়ার চেষ্টা করেছিল ।’
উদাহরণ স্বরূপ ডক্টর আহমাদী ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে কাফিরিস্তানে আমির আবদুল রহমান খানের আক্রমণের কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে সেই আক্রমণে আবদুল রহমান কাফিরিস্তানের সমস্ত ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক নিদর্শন পুড়িয়ে ফেলেন এবং এমনকি এর নাম পরিবর্তন করে “নূরিস্তান” রাখেন । তার মতে, এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ২০০১ সালে তালিবানরা একই পদ্ধতিতে বামিয়ান উপত্যকায় বিশালাকার বুদ্ধ মূর্তিগুলি ধ্বংস করে। ডক্টর আহমাদির বলেন, তালিবানরা কামান, ট্যাঙ্ক, রকেট, মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়ে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করতে পারেনি যতক্ষণ না তারা সালসাল এবং শাহমামার মূর্তিগুলিতে বিস্ফোরক সামগ্রী লাগানোর জন্য স্থানীয় বেসামরিক লোকদের ভাড়া করে ।’।