এইদিন ওয়েবডেস্ক,নয়াদিল্লি,১১ নভেম্বর : ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের সংবিধানের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন হয় । সংবিধানের প্রথম পৃষ্ঠাতে ছিল পদ্মফুলের মত ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক । এছাড়া প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে ছিল ভগবান শিব,ভগবান রাম,ভগবান বুদ্ধ অথবা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছবি । ছিল ‘দ্য লিবারেটর অফ ভারত’ নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোসের ছবিও । রানী লক্ষ্মী বাঈ, শিবাজি মহারাজ, গুরু গোবিন্দ সিংয়ের ছবিও কোনো কোনো অধ্যায়ের প্রথমেই স্থান দেওয়া হয়েছিল । প্রতিটি ছবির পিছনেই ছিল গূঢ় বার্তা ।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে যুক্ত ওই সমস্ত হিন্দু দেবদেবী ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরা ছবিগুলি সরিয়ে দেওয়া হয় জহরলাল নেহেরুর নির্দেশে ।
কি বার্তা দেওয়া হয়েছিল ওই ছবির মাধ্যমে ? কেনই বা নেহেরু সংবিধান থেকে ওই সমস্ত ছভিগুলি সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ? এই সমস্ত প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায় । সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিওতে অশ্বিনী উপাধ্যায় তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই বলেন,’ ‘কংগ্রেসের মানসিকতা বুঝতে হলে সংবিধানকে বুঝতে হবে৷ যখন ভারতের সংবিধান হয়েছিল তখন প্রথম পাতা স্বর্ণালি রঙের ছিল,আর চারিদিকে ছিল পদ্মফুল আঁকা । কিন্তু স্যেকুলারিজমের নামে প্রথম পাতাটাই সরিয়ে দেওয়া হল ।’
তিনি বলেন,’সংবিধানের মোট ২২ টা বিভাগ আছে৷ প্রত্যেক বিভাগের প্রথমে একটা করে চিত্র ছিল ।
প্রথম বিভাগে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন স্বরূপ ছবি ছিল । সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন থেকে ভারতের ঝলক আসে । সিন্ধু সভ্যতাকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা হিসাবে মনে করা হয় । আমরা সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে গর্ববোধ করি,এই কারনে ওই ছবি সরিয়ে দেওয়া হল।’
ভারতীয় সংবিধানের বাকি অধ্যায়ের শুরুতে থাকা ছবিগুলি সম্পর্কে অশ্বিনী উপাধ্যায়ের বক্তব্য পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হল :-
দ্বিতীয় অধ্যায় : ‘দ্বিতীয় অধ্যায় দেশের নাগরিকদের সম্পর্কীয় । ওখানে সিটিজেন শিপ অ্যাক্ট হবে, আর্টিকেল ৫ থেকে আর্টিকেল ১১ পর্যন্ত এই অধ্যায়ে আছে । আপনারা কি জানেন কি ছবি ছিল ওই বিভাগের শুরুতে ? ওখানে গুরুকুলের ছবি ছিল । এটাই লক্ষ্য ছিল যে সব ভারতীয় গুরুকুল শিক্ষায় শিক্ষিত হোক । কিন্তু সংবিধানের দ্বিতীয় বিভাগে গুরুকুলের ছবিটাই সরিয়ে দেওয়া হল ।’
তৃতীয় অধ্যায় : ‘তৃতীয় অধ্যায়, যাকে আমরা মৌলিক অধিকার বলি । ওই অধ্যায়ের প্রথম পাতায় ছিল পুষ্পক বিমানে আরূঢ় ভগবান শ্রীরাম-লক্ষণ ও দেবী সীতার ছবি । দেশে মৌলিক অধিকার নিয়ে খুব চর্চা হয়,কিন্তু তৃতীয় অধ্যায় থেকে ভগবান শ্রীরাম- লক্ষণ ও দেবী সীতার ছবিটাই সরিয়ে দেওয়া হল । আমার মনে হয়, ১৯৭৭ সালে যে সেক্যুলারিজম শব্দ এলো, তার ভিতটা গড়ে গেছেন জহরলাল নেহেরু । কারন যদিও সংবিধানের ২২ টি চিত্র যদি থাকতো তাহলে ইন্দিরা গাঁধি সেক্যুলার শব্দটা জুড়তে পারত না । সেই কারনে নেহেরু প্রথমে ছবি সরালো,পরে ইন্দিরা সেক্যুলার শব্দ জুড়ে দিল ।’
চতুর্থ অধ্যায় : চতুর্থ অধ্যায়টি রাষ্ট্রীয় নির্দেশমূলক । ওই অধ্যায়ের শুরুতে কুরুক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দেওয়ার মুহুর্তের ছবি ছিল । তাতে বার্তা দেওয়া হয় যে সরকার ধর্মনিষ্ঠার সাথে কাজ করবে । সরকার কি কি করবে তার বিবরণ তাতে দেওয়া আছে । যেমন গোহত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, সবাইকে রোটি-কাপড়া ও মকান দেওয়ার কথা বলা আছে । কিন্তু কংগ্রেস ওই ছবিটাও সরিয়ে দিল ।’
পঞ্চম অধ্যায় : ‘পঞ্চম অধ্যায়ের গৌতম বুদ্ধজি সবাইকে ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছেন, এমন মুহুর্তের ছবি ছিল । ওই ছবিও সরিয়ে দেওয়া হল ।’
ষষ্ঠ অধ্যায় : ‘ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমাদের ২৪ তীর্থঙ্কর ভগবান মহাবীরের ছবি ছিল । কংগ্রেস ভগবান মহাবীরের ছবিও সরিয়ে দিল ।’
সপ্তম অধ্যায় : ‘সপ্তম অধ্যায়ের ছবিতে সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে আলোচনা রত অবস্থায় দেখানো হয়েছিল । সেই ছবিও সরিয়ে দিল।’
অষ্টম অধ্যায় : ‘অষ্টম অধ্যায়ে হনুমানজির ছবি ছিল । হনুমানজি দেবীর সীতাকে আকাশ থেকে খুঁজছেন, এমন ছবি ছিল । যদি হনুমানজির ছবি থাকত তাহলে সেক্যুলার শব্দ আসত না,সেই কারনে নেহেরু হনুমানজির ছবিটাই সরিয়ে দিল ।’
নবম অধ্যায় : ‘নবম অধ্যায়ে রাজা বিক্রমাদিত্য বত্রিশ সিংহাসনে বসে জনগনের সাথে ন্যায় করছেন,এমন ছবি ছিল । গোটা পেজটাই গায়েব করে দেওয়া হল ।’
দশম অধ্যায় : ‘দশম অধ্যায়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছবি ছিল, যেটি বখতিয়ার খিলজি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমাদের কাছে যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, সেটা জানানোই মূল লক্ষ্য ছিল । দূর্ভাগ্যবশত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছবিটাই গায়েব করে দেওয়া হল ৷’
একাদশ অধ্যায় : ‘একাদশ অধ্যায়ে ছিল রাজা ভরতের ছবি । যার নাম অনুসারে আমাদের দেশের নাম ভারত হয়েছিল । এই যে ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া করে সব চিৎকার করে, নেহেরুও ইন্ডিয়া নামের প্রতি ঝোঁক ছিল । এই কারনে নেহেরু রাজা ভরতের ছবিটাই গায়েব করে দিলেন ।’
দ্বাদশ অধ্যায় : ‘দ্বাদশ অধ্যায়ে নটরাজের রূপে ভগবান মহাদেবের ছবি ছিল । নেহেরু ওই ছবিও গায়েব করে দিল ।’
ত্রয়োদশ অধ্যায় : ‘ত্রয়োদশ অধ্যায়ে রাজা ভগিরথ ও গঙ্গাজির অবতারের ছবি ছিল । গঙ্গাজি উপরের দিকে বসে আছেন, নিচে বসে আছেন রাজা ভগিরথ,এমন ছবি ছিল। ওই ছবিও গায়েব করে দেওয়া হয়েছে ।’
পনেরো অধ্যায় : ‘পনেরো অধ্যায়ে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ও গুরু গোবিন্দ সিংজির ছবি ছিল । এই অধ্যায় নির্বাচন সম্পর্কীয় । উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে ভোট দিতে যাওয়ার সময় ভোটাররা একবার ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ও গুরু গোবিন্দ সিংজিকে স্মরণ করুক । ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ও গুরু গোবিন্দ সিংজি না থাকলে আপনারা বর্তমান ভারতকে দেখতে পেতেন না । আজকের ভারত কোনো নেতা বা অভিনেতার কারনে সৃষ্টি হয়নি । বাস্তবে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ও গুরু গোবিন্দ সিংজির কারনেই আজকের ভারত এই স্থানে এসেছে । ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ মুঘলদের না রুখলে কি হত ভগবানই জানেন । গোবিন্দ সিংজি শিখপন্থের স্থাপনা না করলে কি হত কল্পনাও করা মুসকিল । এই কারনে ওনাদের ছবি রাখা হয়েছিল। কারন ভোট দেওয়ার সময় সর্বদা ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ও গুরু গোবিন্দ সিংজিকে স্মরণ করার বার্তা দেওয়া হয়েছিল ওই ছবির মাধ্যমে । জাতি, ভাষা,ক্ষেত্র দেখে ভোট দেবেন না, বরং রাষ্ট্রকে সর্বোপরি রেখে ভোট দিন,এই বার্তাই দেওয়া হয়েছিল ওই ছবির মাধ্যমে । কিন্তু ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ও গুরু গোবিন্দ সিংজির ছবিই গায়েব করে দেওয়া হল ।’
ষোল অধ্যায় : ‘যোল অধ্যায়ে রানী লক্ষ্মীবাইয়ের ছবি ছিল । কংগ্রেস আর নেহেরু সেই ছবিও সরিয়ে দিল ।’
সতেরো ও আঠারো অধ্যায় : ‘সতেরো অধ্যায়ে নমক সত্যাগ্রহে ডান্ডি মার্চের ছবি ছিল । আঠারো অধ্যায়ে আজাদ হিন্দ ফৌজকে স্যালুট করছেন নেতাজি, এমন ছবি ছিল । ভাবুন,নেতাজিকে কতটা ঘৃণা করত কংগ্রেস । আমার তো মনে হয়, নেতাজির ছবি সরানোর জন্যই বাকি ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে । আর এটাও হতে পারে যে সেক্যুলার শব্দ ঢোকানো, সংবিধানের প্রাথমিক কাঠামো বদলানোর জন্য ওই সমস্ত ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে । আসলে প্রস্তাবনায় সেক্যুলার শব্দ ঢুকিয়ে সংবিধানের প্রাথমিক কাঠামোকেই বদলে ফেলা হয়েছে ।’
অশ্বিনী উপাধ্যায় বলেন,’এই পরিকল্পনা সেই সময়েই নেহেরু করে ফেলেছিল। কারন তিনি জানতেন যে সংবিধানের ২২ টি ছবি বহাল থাকলে পরে আর সেক্যুলার শব্দ জুড়তে পারবে না । সেই কারনে মেয়ে ইন্দিরারা রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য নেহেরু ওই ২২ টি ছবি সরিয়ে ফেলেন ।’
কুড়ি, একুশ ও বাইশ অধ্যায় : ‘কুড়ি অধ্যায়ে হিমালয় পর্বতের ছবি ছিল । একুশ অধ্যায়ে মরুভুমিতে উটের সারির ছবি এবং বাইশ অধ্যায়ে সমুদ্রের ঢেউ কাটিয়ে জাহাজের এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের ছবি ছিল ।’
তিনি বলেন,’এই সব ছবি ভারতীয়তা মজবুত করার লক্ষ্যে, সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে, ভারতের সংস্কার ও ভারতীয় পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে রাখা হয়েছিল সংবিধানে । যদি ওই ছবিগুলি আমাদের সংবিধানে থাকতো তাহলে কংগ্রেসের সরকার কখনো সেক্যুলার শব্দ জুড়তে পারত না । যদি আজ ওই ২২ টি ছবি সংবিধানে থাকতো তাহলে আজ সেক্যুলারিজমের নামে দেশে যে নগ্ন নৃত্য চলছে,সেক্যুলারিজমের নামে তুষ্টিকরণ হচ্ছে,হয়ত এগুলো বন্ধ হয়ে যেত ।’
তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আহ্বান জানান,’আমি আপনাদের কাছে হাত জোড় করে নিবেদন করছি যে বাস্তবিক যদি দেশকে আপনারা ভালোবাসেন তাহলে আপনারা নিজের নিজের এলাকার সাংসদ বিধায়কদের বলুন ওই ২২ টি ছবি সংবিধানে ফের বহাল করা হোক । আমাদের ভারতের সংবিধানে ভারতীয় দর্শন,ভারতের রীতিনীতি, ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন মহাপুরুষ,ভগবান বিষ্ণু, ভগবান শঙ্কর,ভগবান রাম,ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ছবি থাকা আবশ্যক । প্রথমে ওই সমস্ত ছবি ছিল, তাহলে কেন এখন সংবিধানে ওই সমস্ত ছবি থাকবে না ? এটা ভারতের সংবিধান, ইউরোপ বা আরবের সংবিধান নয় ।’
অশ্বিনী উপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে আবেদন জানান যে ভারতীয় সংস্কৃতিকে মজবুত করতে ওই ২২ টি ছবি ফিরিয়ে আনা হোক । এজন্য একটা কমিটি গঠন করে ওই ছবিগুলিকে সংবিধানের মধ্যে ফের ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি ।।